' ক্যাংকা আছিস বন্ধু, কী করিচ্চু তুই?'

বগুড়ার নামুজা উচ্চবিদ্যালয়ের ১২৫ বছর পূর্তি উৎসব ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে র‌্যালি। ছবি: প্রথম আলো
বগুড়ার নামুজা উচ্চবিদ্যালয়ের ১২৫ বছর পূর্তি উৎসব ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে র‌্যালি। ছবি: প্রথম আলো

তাঁদের দেখা হয় না কত দিন! জীবন গিয়েছে চলে কত কুড়ি কুড়ি বছর! কিন্তু ফেলে আসা জীবনের কথা কি ভোলা যায়? স্কুলজীবনের বন্ধুত্বের সোনালি সেই দিনগুলোর স্মৃতিতে এখনো জমেনি একরত্তি ধুলো।

দীর্ঘদিন পর শৈশবের প্রিয় বিদ্যাপিঠে ১২৫ বছর পূর্তি উৎসবে যোগ দিতে এসে প্রিয় সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অনেকটা আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন সবাই। একে অন্যকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বগুড়ার যে ভাষা দিয়ে জীবনটা শুরু, আজ সেই ভাষাইতেই উঠে আসে সম্বোধ: ‘বন্ধু, তোর খবর কী রে?’, ‘ক্যাংকা আছিস বন্ধু?’, ‘কী করিচ্চু তুই?’। একজন জবাব দিলেন, ‘বিচার বিভাগে, আরেকজন বললেন, জেলা সাবরেজিস্ট্রারের পদে চাকরি করিচ্চি।’

বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ নামুজা উচ্চবিদ্যালয়ের ১২৫ বছর পূর্তি উৎসব ও পুনর্মিলনী অনষ্ঠোনে যোগ দিতে এসে বিদ্যালয়ের নবীন-প্রবীণ সব শিক্ষার্থী এভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন পর বন্ধুরা একসঙ্গে হয়ে সারা দিন আড্ডা, হাসি, স্মৃতিচারণা আর নাচ-গানে মেতে ওঠেন।

আজ বুধবার প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের উপস্থিতিতে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও বেলুন-ফেস্টুন উড়িয়ে দুই দিনব্যাপী এ উৎসবের উদ্বোধন করা হয়।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভুপাল চন্দ্র প্রামাণিক দুই দিনব্যাপী উৎসবের উদ্বোধন করেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। বাদক দলের সুরে ও ঢোলের ছন্দে, টমটম গাড়িতে চড়ে প্রাক্তন, নবীন ও প্রবীণ শিক্ষার্থীরা নেচে-গেয়ে আনন্দযাত্রার মাধ্যমে নামুজা ও বুড়িগঞ্জ বন্দর ঘুরে আসেন। সবার গায়ে ছিল সাদা টি–শার্ট এবং সাদা রঙের সান ক্যাপ। বন্দর ঘুরে শোভাযাত্রা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ফিরে আসার পর উৎসব মঞ্চে বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থী আনন্দঘন মুহূর্ত মুঠোফোনে ক্যামেরাবন্দী করে রাখেন। সেলফি, আড্ডা, খুনসুটিও চলে কিছুক্ষণ।

পরে উৎসব মঞ্চে স্মৃতিচারণা করেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। এ পর্বে একে একে স্মৃতিচারণা করেন বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও নাটোর জেলা রেজিস্ট্রার এসকেন্দার আলী, বিচার বিভাগে সিনিয়র জুডিশিয়াল অফিসার পদে কর্মরত এস কে সাহা চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত জেলা খাদ্য কর্মকর্তা শামসুল হুদা, ঠাকুরগাঁও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা পদে কর্মরত আফতাব হোসেন, নরসিংদী সরকারি কলেজের শিক্ষক আবদুস সামাদ, সোনালী ব্যাংক বগুড়ার প্রধান শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক এ কে এম আবদুল হান্নান, শরীয়তপুরে সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা পদে কর্মরত মাহবুবর রহমান, নামুজা ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রিয়াজ উদ্দিন, বেসরকারি সংস্থা নিডোর নির্বাহী পরিচালক রফিকুল ইসলাম, পুলিশ কর্মকর্তা মাকসুদুর রহমান, ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এবং নামুজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম রাসেল মামুন ছাড়াও অনেকেই। প্রধান শিক্ষক ভুপাল চন্দ্র প্রামাণিক এ পর্বে সভাপতিত্ব করেন। এ সময় বিদ্যালয়ের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংকলনের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র বিচার বিভাগে সিনিয়র জুডিশিয়াল অফিসার পদে কর্মরত এস কে সাহা চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘এ বিদ্যালয়ে পড়ে আমি যেটুকু শিখেছি, সেটুকুই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।’

নামুজা ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রিয়াজ উদ্দিন বলেন, মানুষের অর্থ থাকতে পারে, সম্পদ থাকতে পারে, কিন্তু সব অর্থশালী ও সম্পদশালী মানুষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। ১২৫ বছর আগে শিক্ষানুরাগী মানুষ এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন।

অবসরপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা শামসুল হুদা স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘বহু বছর আগে এ বিদ্যালয় ছেড়েছি। সে সময়ে সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্বটা ছিল অনেক নির্মল। বন্ধুত্বে ছিল না কোনো দ্বন্দ্ব। এখন বাস্তবতার কারণে দূরত্ব এলেও বন্ধুত্বের নির্মল সম্পর্কটা মুছে যায়নি।’

নরসিংদী সরকারি কলেজের শিক্ষক আবদুস সামাদ বলেন, ‘শৈশবের রঙিন সেই সময়টাতে বন্ধুত্ব মানেই ছিল পাগলামি। আমাদের মধ্যে ঝগড়া হতো। তবে সেই ঝগড়ায় কোনো ক্রোধ ছিল না। আজ একেবারে চিৎকার-চেঁচামেচি করা ঝগড়া তো পরদিন আবার দেখা যেত গলায় গলায় ভাব। অতীতের মতো রাত-দিন এক করে আড্ডা দেওয়ার ইচ্ছা জাগে। হঠাৎ করেই বন্ধুর কথা মনে করে বলতে ইচ্ছে করে, “ক্যাংকা আছিস, বন্ধু?”’

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভুপাল চন্দ্র প্রামাণিক তাঁর বক্তব্যে বলেন, দীর্ঘ এই পথচলায় বিদ্যাপীঠটি অসংখ্য গুণীজনের জন্ম দিয়েছে। এখানকার প্রাক্তন ছাত্রদের অনেকে সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা, শিক্ষক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধিসহ নিজ নিজ পেশায় সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখছেন।

বিদ্যালয়ের গৌরবের ইতিহাসের স্মৃতিচারণা করে প্রধান শিক্ষক বলেন, এলাকার কয়েকজন বিদ্যানুরাগীর প্রচেষ্টায় ১৮৯৪ সালে নামুজা মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভের পর নামুজা হাই ইংলিশ স্কুল নামে কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৩৫ সালে প্রথমবারের মতো আটজন শিক্ষার্থী ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নেয়। ১৯৪৮ সালে ইস্টবেঙ্গল সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ডের অধীনে নামুজা উচ্চবিদ্যালয় নামকরণ হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় শ।

স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠান শেষে প্রীতিভোজে অংশ নেন প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। বিকেলে জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রথম দিনে নবীন–প্রবীণ শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা বসে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। কাল বৃহস্পতিবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনে স্মৃতিচারণা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন বিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন সহস্রাধিক শিক্ষার্থী।