দুর্গম পাহাড়ে তিন বিদ্যালয়

>খাগড়াছড়ির দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ছিল না বিদ্যালয়। প্রথম আলোর পাতায় উঠে এসেছিল সেই চিত্র। প্রতিবেদনের পরই প্রতিষ্ঠিত হয় একে একে তিনটি বিদ্যালয়। সেসব বিদ্যালয়ের মাধ্যমে এখন আলোর দিশা পাচ্ছে শত শত পাহাড়ি শিক্ষার্থী।

২০১১ সালের ৫ আগস্ট, বিকেলবেলা। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রাজীব ত্রিপুরার সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন উৎকণ্ঠার কথা, নির্মম এক বাস্তবতার কথা। 

রাজীব ত্রিপুরার কথায় জানা গেল, নয়মাইল এলাকার আশপাশে কয়েকটি গ্রামে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। যাদের সামর্থ্য আছে তারাই কেবল উপজেলা সদরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারছে, সামর্থ্যহীনরা ঝরে পড়ছে প্রাথমিকেই।

পরদিনই আটমাইল, নয়মাইলসহ আশপাশের এলাকার মাধ্যমিকে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললাম। ওদের কষ্টের কথা জানলাম। ঘুরে এসে প্রতিবেদন পাঠালাম। ৭ আগস্ট প্রথম আলোর বিশাল বাংলায় প্রকাশিত হলো ‘একটি বিদ্যালয়ের জন্য এত কষ্ট!’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন। সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পর দীঘিনালা সেনা জোনের তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল নওরোজ এহসান পিএসসি সেনানিবাসে ডাকলেন কথা বলার জন্য। দীর্ঘ আলোচনার পর তিনি জানালেন, নয়মাইল এলাকায় সেনাবাহিনী একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। 

যেমন কথা তেমন কাজ। জায়গাজমি নির্ধারণ করে ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ শুরু হলো। ২০১১ সালের ৩১ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হলো বিদ্যালয়টি। এ ছাড়া প্রতিবেদন প্রকাশের পর জার্মানপ্রবাসী সৈয়দ শাকিল ৬ জন শিক্ষকের এক বছরের বেতন, ৯টি সেলাই মেশিন ও প্রথম আলো প্রতিনিধির মাধ্যমে বিদ্যালয়ের রিজার্ভ ফান্ডের জন্য ৫০ হাজার টাকা এবং আনুষঙ্গিক খরচের জন্য ৩০ হাজার টাকা অনুদান দিলেন। চলতে থাকল স্কুলের কার্যক্রম।

বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ১৩৯ জন শিক্ষার্থী ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে।

নয়মাইল ত্রিপুড়া পাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এখন পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে অনেক পাহাড়ি শিক্ষার্থী।
নয়মাইল ত্রিপুড়া পাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এখন পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে অনেক পাহাড়ি শিক্ষার্থী।

আবারও সেই রাজীব ত্রিপুরা

একটি নিমন্ত্রণে হাজির হয়ে রাজীব ত্রিপুরার সঙ্গে সাক্ষাৎ। নানা বিষয়েই তাঁর সঙ্গে কথা হয়। সেই কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, হাজাছড়া জোড়াব্রিজ এলাকায় ১২টি গ্রামের ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। কারণ, আশপাশের ১০-১২ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। 

বিষয়টি সরেজমিন দেখতেই বেরিয়ে পড়ি ২০১২ সালের ২৩ মার্চ। ১২টি গ্রামের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলি, ফিরে এসে ছবিসহ প্রতিবেদন পাঠাই। পরদিন ২৪ মার্চ প্রথম আলোর বিশাল বাংলা পাতায় ‘গাড়ি না পেলে বাড়ি ফেরত’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এবার আবারও রাজীব ত্রিপুরা ও আমার ডাক পড়ল সেনা জোনে। তৎকালীন জোন অধিনায়ক লে. কর্নেল নওরোজ এহসান পিএসসি জানালেন, হাজাছড়া জোড়াব্রিজ এলাকায় একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন। 

২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হলো সেই বিদ্যালয়, যে বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে এগিয়ে এসেছিল দীঘিনালার মেসার্স কাশেম অ্যান্ড ব্রাদার্স। তারা এক লাখ টাকা অনুদান দেয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ১২টি গ্রামের ২০৬ জন শিক্ষার্থী ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালার জোড়াব্রিজ এলাকার জোড়াব্রিজ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার জোড়াব্রিজ এলাকার জোড়াব্রিজ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়।

ভোরে যাত্রা, সন্ধ্যায় ফেরা

দীঘিনালা থেকে খাগড়াছড়ি জেলা শহরে যাওয়া–আসার পথে একটি দৃশ্য কৌতূহলী করে তুলেছিল। সাতসকাল কিংবা অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধ্যা, নয়মাইল এলাকায় মূল সড়কের পাশ দিয়ে বই–খাতা হাতে দল বেঁধে পাহাড়ি শিশুদের যাতায়াত দেখা যেত। একদিন শিশুদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, তাঁরা দুর্গম সীমানা পাড়া থেকে ভোর পাঁচটায় দল বেঁধে হেঁটে নয়মাইল ত্রিপুরা পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসে। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। 

একদিন ভোর পাঁচটায় সীমানা পাড়া এলাকার মাঝামাঝি একটি জায়গায় সড়কের পাশে দাঁড়ালাম। দেখে আমরা অবাক, শিশুরা যা বলেছে তা–ই সত্যি। প্রাক্​প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভোর পাঁচটায় বিদ্যালয়ে চলে আসছে দল বেঁধে। আবার ফিরবে দল বেঁধে। নয়মাইল ত্রিপুরা পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে সত্যতা পেলাম। বিদ্যালয়ে যাওয়া–আসা ও গ্রামের সার্বিক চিত্রসহ প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠালাম। এবার পড়লাম বড় ফ্যাসাদে! সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনির বললেন, আপনি আবার সীমানাপাড়া গ্রামে যাবেন। কত শিশু বিদ্যালয়ে যায়, কত শিশু পড়াশোনা করে না, গ্রামে শিশুর সংখ্যা কত—সব মিলিয়ে আবার প্রতিবেদন পাঠান। 

আবার সীমানাপাড়া যাওয়া। এবার সেসব তথ্য যোগ করে ছবিসহ প্রতিবেদন পাঠালাম। ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘আমার চট্টগ্রাম’ পাতায় ‘ভোর পাঁচটায় বিদ্যালয়ে যাত্রা, সন্ধ্যা সাতটায় ফেরা’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। ওই দিন বেলা ১১টায় একটি অপরিচিত নম্বর থেকে আমার মুঠোফোনে একটি কল এল। ওপাশ থেকে পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমি জীবন মুছা চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মনজুর আলমের পিআরও। আপনার প্রতিবেদন মনজুর সাহেব দেখেছেন। তিনি দুর্গম এলাকায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দেবেন।’

হোসনেয়ারা মনজুর বিদ্যানিকেতনের খুদে শিক্ষার্থীদের দৌড়টা ছুটির আনন্দে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের পর। ছবি: ছুটির দিনে
হোসনেয়ারা মনজুর বিদ্যানিকেতনের খুদে শিক্ষার্থীদের দৌড়টা ছুটির আনন্দে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের পর। ছবি: ছুটির দিনে

আমাকে সাবেক মেয়র মনজুর আলমের মুঠোফোন নম্বর দিলেন কথা বলার জন্য। মনজুর আলমের সঙ্গে কথা হলো। তিনি তাঁর আগ্রহের কথা জানালেন। এরপরই মনজুর আলমের সামাজিক সংগঠন মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন কাজ শুরু করল। সীমানাপাড়া গ্রামে ৪০ লাখ টাকা খরচ করে ১০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪০ ফুট প্রস্থ তিনতলা ফাউন্ডেশনের হোসনেয়ারা মনজুর বিদ্যানিকেতনের ভবন নির্মাণ করা হলো। ২০১৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর উদ্বোধন হলো হোসনেয়ারা মনজুর বিদ্যানিকেতন। সেখানে প্রথম বছরে ১০৬ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। বর্তমানে ১৩২ জন শিক্ষার্থী প্রাক্​প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতিবছর নতুন পোশাক, জুতা, সোয়েটার ও একটি করে কম্বল দেওয়া হয়। বিদ্যালয়ের ৬ জন শিক্ষক, শিক্ষিকা ও কর্মচারীর বেতন দেওয়া হয়।

দীঘিনালার পশ্চাৎপদ এ তিনটি এলাকায় প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কল্যাণে দুটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিদ্যালয়গুলোতে শত শত শিক্ষার্থী পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। এই তিনটি এলাকায় গেলে সেখানকার বাসিন্দারাও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।