যুক্তির লড়াই থেকে পরিবর্তনের চর্চা

বিজয়ী দলের সঙ্গে আয়োজক ও অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো
বিজয়ী দলের সঙ্গে আয়োজক ও অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো

‘ছোটবেলা থেকেই আমি যখন দেখব, আমার বাবা মায়ের সঙ্গে গৃহস্থালির সেবামূলক কাজে সাহায্য করছেন, তখন বুঝব এ কাজ দুজনেরই। পরবর্তীকালে আমি আমার স্ত্রীকে সাহায্য করব। এভাবেই পুরুষদের গৃহস্থালির সেবামূলক কাজে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমেই সমাজের মানসিকতা পরিবর্তন সম্ভব’—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতার্কিক শাইয়ান সাদিকের কথা থেকেই পুরো আয়োজনের একটা সারমর্ম পাওয়া যায়। 

গত ২২ ডিসেম্বর। রাজধানীর ফার্মগেটে ডেইলি স্টার ভবন মিলনায়তনে ‘একশনএইড-প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় বিতর্ক উৎসব ২০১৯’–এর চূড়ান্ত পর্বে বক্তব্য দিয়েছেন শাইয়ান সাদিকসহ অনেকেই। বিতার্কিকেরা যুক্তির লড়াইয়ের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করছিলেন—গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে কীভাবে এগোতে হবে, এ–সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের পথগুলোই–বা কী। 

একশনএইড বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ‘গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন: আনবে সমতা, করবে উন্নয়ন’ স্লোগানে আয়োজিত বিতর্ক উৎসবে গত বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ৬টি বিভাগের ৭০টি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর ও চট্টগ্রামের ৬টি পর্ব থেকে নির্বাচিত মোট ১২টি দল নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় চূড়ান্ত পর্ব। মোট বিচারক ছিলেন ১২৬ জন। প্রতিটি আঞ্চলিক পর্বে ছিল একটি বিতর্কবিষয়ক কর্মশালা। এতে অংশ নেন মোট ১ হাজার ১০০ জন প্রশিক্ষণার্থী। পুরো আয়োজনে সহযোগিতা করেন প্রথম আলো বন্ধুসভার ৩১০ জন বন্ধু। 

চূড়ান্ত বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যরা। দলনেতা ছিলেন রোকেয়া আশা, আল রাব্বি ও মণিকা ইয়াসমিন। রানার্সআপ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী—শাইয়ান সাদিক, রিফাত আফসার খান ও জুবায়ের আবদুল্লাহ। আর বিতর্ক উৎসবে সেরা বক্তা নির্বাচিত হন শাইয়ান সাদিক। বিতর্ক পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আব্দুন নূর তুষার।

বিতর্ক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন একশনএইড বাংলাদেশের ‘পাওয়ার’ প্রকল্পের লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নারী কৃষক ও অংশগ্রহণকারী গৃহিণীরা। কেউ বক্তব্য দিয়েছেন, কেউ পুরস্কার তুলে দিয়েছেন বিজয়ীদের হাতে। এই নারীরা জীবনের অনেকটা সময় পার করেছেন সাংসারিক কাজে। কিন্তু এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন, এ ছাড়া স্বামীরাও এখন তাঁদের সঙ্গে গৃহস্থালি কাজ ভাগ করে নেন।

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম। সভাপতিত্ব করেন একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির। অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, বন্ধুসভার জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সাইদুজ্জামান, একশনএইড ইন্টারন্যাশনালের সাউথ এশিয়া অ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর মো. হেলাল উদ্দিন। আরও উপস্থিত ছিলেন একশনএইডের কর্মসূচি কর্মকর্তা নূরে জান্নাত প্রমা ও পাওয়ার প্রকল্পের সমন্বয়কারী ইসরাত জাহান। 

বিতর্কের এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন সারা দেশের ৭০টি কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
বিতর্কের এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন সারা দেশের ৭০টি কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

প্রধান অতিথির বক্তব্যে শামসুল আলম বলেন, ‘গৃহস্থালির সেবামূলক কাজে নারীর মূল্যায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কাজের স্বীকৃতি দিতে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক। ঘরের বাইরে পুরুষ ৮১ শতাংশ এবং নারী ৩৬ শতাংশ কাজ করেন। নারীদের ঘরের কাজ বেশি। শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী নারীদের কাজের মূল্য নির্ধারণ করে প্রকাশ করতে হবে।’

একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘আমরা মনে করি, নারীরা যে কাজটা করছেন, সেটা অনেক সময় স্বীকৃতি পায় না। সেই স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য, তাঁর কাজের নমুনা, কাজের বৈচিত্র্য, ক্ষেত্রগুলো এবং কাজের বোঝা আমরা পরিবারে ও সমাজে বুঝতে পারি না। সে কারণে কয়েক বছর ধরে আমরা সবাই মিলে আন্দোলন করছি নারীর গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের স্বীকৃতির জন্য। সেই স্বীকৃতি পরিবার ও সমাজে যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন রাষ্ট্রের নীতি ও আইনেও।’ 

গত বছরের ২৬ অক্টোবর। সেদিনের সকালটা ছিল একটু অন্য রকম। রাজধানীর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ৭১ মিলনায়তনে উপস্থিত পুরুষেরা চলে আসেন অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চে। ডান হাত সামনে তুলে একসঙ্গে বলেন, ‘আজ থেকে আমি আমাদের বাসায় যে কাজগুলো আছে, যে কাজগুলো আমাদের বোনেরা করেন, মায়েরা করেন, স্ত্রীরা করেন—গৃহস্থালির সব কাজ ভাগাভাগি করে সম্পন্ন করব।’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ শপথ পড়ান প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সাইদুজ্জামান। 

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা বিতার্কিকদের সামনে একটি জরিপ তুলে ধরেন। জরিপে দেখা যায়, একজন নারীকে দৈনিক সাড়ে ছয় ঘণ্টার বেশি গৃহস্থালির সেবামূলক কাজ করতে হয়, যার কোনো আর্থিক মূল্য তিনি পান না।

একশনএইডের পক্ষ থেকে সামগ্রিক এই প্রচারাভিযানের সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন কর্মসূচি কর্মকর্তা নূরে জান্নাত। দেশব্যাপী আঞ্চলিক পর্যায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন না হওয়ার পেছনে গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের অসম বণ্টন যে দায়ী, সে বিষয়টি তিনি তুলে ধরেন।

চূড়ান্ত পর্বের বিতর্কে স্পিকার ছিলেন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার, বিরূপাক্ষ পাল, বিচারক হিসেবে ছিলেন শাকিল মাহবুব, উত্তম রয়, মাহফুজ মিশু, মাহফুজা লিজা ও আবদুল্লাহ আল চৌধুরী।