কেন পড়ব উদ্ভিদবিজ্ঞান

মানুষের কল্যাণে উদ্ভিদ জড়িত ওতপ্রোতভাবে। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
মানুষের কল্যাণে উদ্ভিদ জড়িত ওতপ্রোতভাবে। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, প্রকৌশল...কত রকম বিষয় আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। কোন বিষয়ে আমি পড়ব, সিদ্ধান্ত নেওয়াই কঠিন। স্বপ্ন নিয়ের এই বিভাগে আমরা একেকটি বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আজ উদ্ভিদবিজ্ঞান সম্পর্কে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও শৈবালবিজ্ঞানী মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী।

কী পড়ানো হয়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণিবিজ্ঞান মিলে একটা বিভাগ ছিল—জীববিজ্ঞান নামে। পরে আলাদা হয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বেশ কিছু শাখা হয়। মাইক্রোবায়োলজিতে (অণুজীববিজ্ঞান) আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসসহ অন্য অণুজীবগুলো নিয়ে পড়াই। এগুলো সবকিছুই মানবজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ এগুলো মানুষ ও উদ্ভিদ উভয়েরই রোগ সৃষ্টি করে৷ মূলত উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের সব বিষয়েই সমান জ্ঞান থাকে৷ আবার বড়-ছোট সব ধরনের উদ্ভিদ নিয়েই কিন্তু পড়ালেখা করে শিক্ষার্থীরা। যদি ব্লু ইকোনমির কথা বলি, তা কিন্তু সামুদ্রিক শৈবালের মাধ্যমেই সম্ভব হচ্ছে৷ আমাদের খাবারদাবার থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রিগুলোতেও এই শৈবালই ব্যবহার করা হচ্ছে৷ শৈবালবিদ্যা সেখানে কাজে লাগছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ থেকে শৈবাল দিয়ে আমরা ন্যানো ফিল্টার তৈরি করেছি৷ বিষয়ভিত্তিক পড়ালেখার বাইরে চলছে গবেষণাও। 

ভবিষ্যৎ কী 

উদ্ভিদ মানেই গাছপালা, সারা পৃথিবীতে এ রকম একটা ধারণা আছে। ঠিক তা নয়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান—এই তিনটির জন্যই আমাদের উদ্ভিদের ওপর নির্ভর করতে হয়। মানুষ সৃষ্টির আগে এই পৃথিবীতে উদ্ভিদের সৃষ্টি হয়েছে। সেখান থেকে মানুষের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পরই মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। যে উদ্ভিদ আমাদের সব দেয়, জীবন রক্ষা করে, যে পরিবেশে আমরা বেঁচে আছি তার ভারসাম্য রক্ষার জন্য আমরা উদ্ভিদের ওপরেই নির্ভরশীল। তাহলে এ বিষয়ের প্রতি আমাদের অনেক বেশি আগ্রহ থাকার কথা ছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন আগ্রহ পাচ্ছে না? কারণ, তৃণমূল পর্যায়ের ছাত্রদের আমরা বিষয়টা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। উদ্ভিদ-প্রাণী সব মিলে কিন্তু আমাদের একটা খাদ্য চক্র (ফুড চেইন)। উদ্ভিদের সঙ্গে আমাদের মিল না থাকলে তা সম্ভব হতো না। সূর্যের শক্তিকে গ্রহণ করে উদ্ভিদ। পরে তা আবার গ্রহণ করে মানুষ। উদ্ভিদ মাটি ও পানি সব জায়গাতেই থাকে। এভাবে একেক স্তরের প্রাণীর খাদ্যাভ্যাস থেকেই বাস্তুতন্ত্র তৈরি। আবার হাজার বছরের পুরোনো উদ্ভিদ মাটির নিচে জমা হয়েই তেল, গ্যাস, কয়লা তৈরি হয়েছে, যা আমরা নিত্যদিনে ব্যবহার করছি। বাতাসে অক্সিজেন আছে প্রায় ২১ শতাংশ, যার মধ্যে ১৭ শতাংশই আসে শেওলা থেকে। বাকি অংশ আসে বড় গাছপালা থেকে। কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে অক্সিজেন হয়তো এসব বড় গাছপালা থেকেই আসে। সেই ডাইনোসর যুগের প্রকাণ্ড গাছপালাগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে তা এই পর্যায়ে এসেছে। সারা পৃথিবীতে বর্তমানে লক্ষাধিক প্রজাতির গাছপালা আছে। 

শস্য উৎপাদন, অ্যাগ্রোস্টলজি, ইকোনমিক বোটানি, হর্টিকালচার, লাইকেনোলজি, মাইকোলজি, অর্কিটোলজি, ফ্যানোলজি, প্লান্ট বায়োটেকনোলজি, জিনোম এডিটিং, বন, ফুড কোম্পানি, সিড ব্যাংকের মতো আরও অনেক ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, আরও হবে। 

জলবায়ু, পরিবেশ, মানুষ—সবকিছুর সঙ্গেই উদ্ভিদ জড়িত। মানবজাতির কল্যাণে, পৃথিবীর জন্য ভবিষ্যতে উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রসার ঘটাতে হবে। খাদ্য গুণাগুণ ঠিক রাখা, প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া ফসল, জলবায়ুর পরিবর্তন রোধসহ মানবজীবনের প্রায় সব বিষয়েই উদ্ভিদবিজ্ঞান জড়িত। এ জন্য উদ্ভিদবিজ্ঞানীও প্রয়োজন। 

কর্মক্ষেত্র 

বাংলাদেশ থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে পড়ে ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরমাণু শক্তি কমিশন, বন বিভাগ, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, খাদ্য অধিদপ্তর, পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, এনআইবি, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরিবেশসম্পর্কিত বিভিন্ন এনজিও, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফার্মাসিউটিক্যাল ইনস্টিটিউট, বায়োটেকনোলজির যতগুলো ল্যাবরেটরি হয়েছে সেখানেও প্রয়োজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী। একইভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের কাজও করছেন তাঁরা। 

আমাদের শিক্ষার্থীরাই এ রকম বিভিন্ন খাতে কাজ করে যাচ্ছে। ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্ভিদবিজ্ঞানী ছাড়া চলবে না। সেখানে কাঁচামালের জন্য উদ্ভিদ লাগে। অন্যদিকে ইনসুলিনও ব্যাকটেরিয়া থেকে তৈরি। সব ভেষজ ওষুধ তৈরি হয় উদ্ভিদ থেকে। উদ্ভিদবিজ্ঞান শুধু উদ্ভিদের ক্ষুদ্র একটা জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই। এর বিস্তৃতি অনেক বড়। আমাদের টেকসই প্রযুক্তির সাহায্যে এটাকে কাজে লাগাতে হবে দেশের কল্যাণে। 

কারা পড়বে

জীববিজ্ঞানের প্রতি যাদের ভালোবাসা রয়েছে, পরিবেশ নিয়ে যারা কাজ করতে চায়, যারা উদ্ভিদ পছন্দ করে—তাদের জন্য এ বিষয়। এ বিষয় নিয়ে পড়ে অনেক ধরনের কাজ করার
সুযোগ রয়েছে। নিজে স্বাবলম্বী হয়ে, দেশ ও জাতির উপকারে আসা যাবে। জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। ব্লু ইকোনমির কথাই ধরা যাক, বঙ্গোপসাগরজুড়ে আমরা সি উইড চাষ করতে পারি। আবার যেমন বর্তমানে ফুলের চাষ থেকে লাভবান হওয়া যাচ্ছে। 

যারা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভাবে, বিজ্ঞানের নতুন নতুন ধারা উন্মোচন করতে চায়, পরিবেশের ও মানুষের জন্য কাজ করতে চায়, টেকসই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে চায়, তাদের জন্যই উদ্ভিদবিজ্ঞান। কারণ, বিজ্ঞানের বিশাল এই অংশে প্রবেশ করতে পারলে তুমি নতুন করে শেখার, জানার, বোঝার ও চর্চা করার সুযোগ পাবে। 


অনুলিখন: মুসাব্বির হুসাইন