ডিএমসির কাছে খোলা চিঠি

ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে–৭২ ব৵াচের শিক্ষার্থীরা। ছবি: এহতেশাম শহীদ
ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে–৭২ ব৵াচের শিক্ষার্থীরা। ছবি: এহতেশাম শহীদ

আর তো মাত্র কয়েকটি দিন। ছয়টা পঞ্চাশে অ্যালার্ম বাজবে না আর। ঘড়িটাকে ‘আর পাঁচ মিনিট’ বলে ফের ঘুমিয়ে পড়া হবে না। আধময়লা অ্যাপ্রন পরে, মিলন চত্বরের হাড়কাঁপানো শীত গায়ে মেখে ক্লাসে ছোটা হবে না। ডিএমসি (ঢাকা মেডিকেল কলেজ), তুমি কি আমাকে মিস করবে?

বছর কয়েক পর, কাজের চাপে যখন প্রচণ্ড চায়ের তৃষ্ণা পাবে, তখন নিশ্চয়ই মনে পড়বে ক্যানটিনের সেই দিনগুলোর কথা। ওয়ান টাইম কাপের সেই পানসে চা! ‘মামা চা এখানে’ বলে চিৎকার করে করে যখন ক্লান্ত হয়ে যেতাম, ঠিক তখনই চায়ের কাপ হাতে পেতাম। সঙ্গে বন্ধুদের অকারণ হাসি, টেবিলে থাবা মেরে কিছু বলা, কিংবা কাউকে অযথাই পচানো! চা যে খুব ভালো হতো, তা নয়। কিন্তু শীতের দিনে ওই প্লাস্টিকের কাপ হাতে নিয়ে যে হালকা ওমটুকু পাওয়া যেত, সেটাও যে আমি ভীষণ মিস করব। তোমার কি আমার কথা মনে থাকবে?

বৃষ্টি হলে তোমার মিলন চত্বরে মন খুলে ভিজবে কেউ? উথালপাতাল পানির ছাঁটে কেউ কি আমার মতো তোমাকে গান শোনাবে? নাচবে দুই হাত মেলে? আমার মতো পাগলি মেয়ে কি তুমি আর পাবে? ঘাসচত্বর কি আগের মতোই থাকবে? তোমার নতুন বাচ্চারা কি পা ঝুলিয়ে বসবে মাঝখানটায়? আড্ডা দেবে? ছবি তুলতে গিয়ে ঘাসগুলো মাড়িয়ে দেবে, ঠিক আমাদের মতো? নাকি তুমি যেমন চাইতে, একদম তেমনই হবে—লক্ষ্মীটি? বয়েজ কমনরুম কি ছেলেদের কোলাহলের শব্দে মেতে উঠবে? টিটি খেলার ছলে অযথাই চিৎকার করে তোমার কানে তালা লাগিয়ে দেবে কেউ? খেলার নেশায় কি আর কারও লেকচার মিস হবে?

ছয়টি বছর তোমার ভেতর আনাগোনা ছিল আমাদের। ক্লাসরুমে যাওয়ার করিডর, ওয়ার্ডে যাওয়ার হাসপাতালের ব্যস্ত সরু পথ মাড়িয়েছি কত! ১ নম্বর গ্যালারির হলুদ প্রজেক্টর কিংবা ওই ফুলওয়ালা মেয়েটার ঘ্যানঘ্যানানি, হাসি, গান, ঠাট্টা, ঝগড়া, অভিমান—সবকিছুর আড়ালে কত কিছুই না শিখিয়ে দিলে! তোমার ওপরও রাগ হয় মাঝেমধ্যে, জানো? লাস্ট স্টেজ ক্যানসারের ওই বুড়ো রিকশাওয়ালার সামনে একা দাঁড় করিয়ে দিলে একদিন। ‘মা, আমি বাঁচমু তো?’—ছলছল চোখের বেঁচে থাকার ওই অদম্য ইচ্ছার সামনে তোমার থার্ড ইয়ারে পড়া ছোট্ট এই মেয়েটা কীভাবে পারবে বলো? কিংবা যেদিন তুমি আমাকে প্রথম মৃত্যু দেখালে, মনে আছে? ঠান্ডা, নিষ্প্রাণ দেহটার সামনে আমি আর আমার বন্ধুটা দাঁড়িয়ে ছিলাম কলের পুতুলের মতো। জীবন নিয়ে বায়না, অহংকার, গর্ব—সব এক মুহূর্তে মাটিতে মিশে গিয়েছিল। নিথর হয়ে যাওয়া মানুষটার মেয়ে কাঁদছিল আকাশ কাঁপিয়ে। কিছুক্ষণ আগেও চা খেতে খেতে হাসি-মজা করা আমি একদম চুপ হয়ে গেলাম। সেই প্রথম আমাকে চুপ দেখেও কেউ জিজ্ঞেস করেনি—‘কী হয়েছে তোর?’ সবাই জেনে গিয়েছিল, ডিএমসি আমাকে প্রথম মৃত্যু দেখিয়েছে।

নাহ, মন খারাপ করব না। ভালো কিছু মনে করি চলো। সন্ধ্যায় ওয়ার্ড করে যখন ফিরতাম, টং থেকে ভেসে আসা চায়ের কাপের টুংটাং শব্দ আমাকে টেনে ধরত। ‘তুই খাওয়া’, ‘না, তুই খাওয়া’, ‘তুই ট্রিট দিবি বলেছিলি’—এমন খুনসুটি নিশ্চয়ই থাকবে। থাকবে মামার চা, ফ্রেঞ্চফ্রাই দিতে দিতে ক্লান্ত হবে দোকানিরা, কিন্তু আমি তো থাকব না! আজ থেকে বছর বিশেক পরও যদি এই ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসি, ডিএমসি, তুমি কি হাজারো কোলাহলের মধ্যে আমার পায়ের শব্দ আলাদা করতে পারবে?

ম্যাজিকের মতো চলে গেল পাঁচটা বছর! ভালোবাসা কী, আমাদের শিখিয়ে তুমি তোমার নতুন বাচ্চাদের বরণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে! স্বীকার করতে লজ্জা নেই, প্রতিবছর তোমার কাছে আসা এই নতুন ব্যাচকে দেখলে হিংসে হয় অনেক। কেন তুমি শুধু আমাদের হতে পারো না? বাহাত্তরের ডিএমসি, বাঁধভাঙার ডিএমসি, আর কারও না! হাসি পাচ্ছে শুনে, না? এত এত মেধাবী মানুষের ভিড়ে এ কোন হিংসুটে মেয়ে ঢুকে পড়ল, তাই না? হিংসুটেই সই। ভালোবাসার ভাগ দিতে কষ্ট হয়, জানো না?

ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শেষ বর্ষ (৭২ ব্যাচ)