কৃষিবিষয়ক উচ্চশিক্ষায়ও এগিয়ে নারী

এবার কৃষিবিষয়ক উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে গেলেন দেশের নারীরা। চলতি শিক্ষাবর্ষে কৃষিবিষয়ক শিক্ষা দেওয়া দেশের সাতটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ছাত্রদের পেছনে ফেলে ছাত্রীরা এগিয়ে রয়েছেন। অভিন্ন প্রশ্নপত্রে এক পরীক্ষার মাধ্যমে এই সাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যত শিক্ষার্থী মনোনীত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৫০ দশমিক ৪২ শতাংশই ছাত্রী। আলাদাভাবেও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী বেশি ভর্তি হয়েছেন।

এর আগে চিকিৎসাশিক্ষাতেও নারীর সংখ্যা পুরুষকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত শিক্ষাবর্ষে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ ছাত্রী এবং ৪০ শতাংশ ছাত্র ছিলেন। এ ছাড়া আরও কয়েক বছর আগেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ভর্তিতে ছাত্রদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় ছাত্রীরা। এখন এই দুই স্তরেই মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী বেশি। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বলছে, প্রাথমিকে এখন মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫০ দশমিক ৭৫ শতাংশ ছাত্রী। আর মাধ্যমিকে ছাত্রীদের এই হার প্রায় ৫৪ শতাংশ। কলেজ ও উচ্চশিক্ষার অন্যান্য স্তরে নারী পিছিয়ে থাকলেও সেখানেও নারীদের অংশগ্রহণ প্রতিবছর বাড়ছে।

এ রকম পরিস্থিতিতে কৃষিবিষয়ক উচ্চশিক্ষায় নারীরা এগিয়ে থাকার তথ্য এল। বিষয়টিকে ইতিবাচক বলছেন একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও কৃষি গবেষণায় যুক্ত ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, এর ফলে দেশের কৃষির ওপরও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে চলতি শিক্ষাবর্ষে (২০১৯-২০) প্রথমবারের মতো কৃষিসংক্রান্ত ডিগ্রি দেওয়া দেশের সাতটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ অভিন্ন প্রশ্নে এক দিনে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। গত ৩০ নভেম্বর এই পরীক্ষা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তিযোগ্য আসন ৩ হাজার ৫৫১টি। এর বিপরীতে আবেদন করেন ৭৫ হাজার ৮৭২ জন। প্রাথমিক বাছাইয়ে বাদ যাওয়ার পর ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন ২৩ হাজার ৪৬৭ জন। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৫ দশমিক ১১ শতাংশ ছাত্র এবং ৪৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ ছাত্রী।

>

কৃষিবিষয়ক সাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে মেধাতালিকায় ৫০.৪২% ছাত্রী। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই হার ৫৪ শতাংশের বেশি।

ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, ছাত্রদের অংশগ্রহণ বেশি হলেও মেধাতালিকায় এগিয়ে যান ছাত্রীরা। মেধাতালিকায় থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০ দশমিক ৪২ শতাংশ ছাত্রী। অন্যদিকে ছাত্রদের এই হার ৪৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ভর্তির কাজ শেষে এখন ক্লাস শুরু হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, আলাদাভাবে পুরোনো ও বড় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের এগিয়ে থাকার চিত্র বেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার প্রথম বর্ষে মোট ১ হাজার ১০৮ জন ভর্তি হন। এর মধ্যে ছাত্রী ৬০৩ জন ও ছাত্র ৫০৫ জন। অর্থাৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ভর্তির হার ৫৪ শতাংশের বেশি।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লুৎফুল হাসান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারই ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা বেশি ভর্তি হলেন। ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করায় ছাত্রীরা মেধাতালিকায়ও এগিয়ে রয়েছেন। এতে দেশের কৃষিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৫১ জন ছাত্রী ও ৩২০ জন ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কামাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, এক-দুই বছর আগে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৩ শতাংশের মতো ছাত্র ভর্তি হতেন। বাকিরা ছাত্রী। এই প্রথম ছাত্রীরা বেশি ভর্তি হয়েছেন। ৫২ শতাংশ ছাত্রী এবং ৪৮ শতাংশ ছাত্র এবার ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছেন। নারীশিক্ষার জন্য সরকারের নানা ধরনের প্রণোদনাসহ বিভিন্ন কারণে এখন নারীরা শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছেন বলে তিনি মনে করেন।

খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১৫০টি আসনের বিপরীতে ভর্তি হয়েছেন ১৪২ জন। তাঁদের মধ্যে ৭৫ জন ছাত্রী, বাকি ৬৭ জন ছাত্র।

কৃষিশিক্ষায় ছাত্রীদের এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পুরো কৃষি খাতের ওপরই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (গবেষণা) তমাল লতা আদিত্য। তিনি নিজেও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী। ১৯৮৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পাস করেন ১৯৯৩ সালে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তখন ১০ থেকে ১২ শতাংশ ছাত্রী ভর্তি হতেন। এখন কৃষিশিক্ষায় ছাত্রীদের এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি অবশ্যই পুরো কৃষি খাতের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। নতুন জাত উৎপাদনসহ কৃষিশিক্ষায় নারীরা এখন ভালো করছেন। চাকরির বাজার বড় প্রসারিত হওয়ায় এবং কৃষি গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষির প্রতি উদ্বুদ্ধ হওয়ায় কৃষিশিক্ষায় নারীরা এগিয়ে আসার কারণ বলে তিনি মনে করেন।