রাবিতে চালু হচ্ছে নতুন সান্ধ্য কোর্স

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

একই বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু আলাদা নিয়ম। নিয়মিত কোর্সে খাতা দেখেন দুজন পরীক্ষক, কিন্তু সান্ধ্য কোর্সে খাতা দেখেন একজন। বিশেষ এই কোর্সের প্রশ্নপত্রও তৈরি করেন একজন। এ ছাড়া পাঠ্যক্রম আলাদা, আর খাতা দেখা হয় উদারভাবে।

এ পরিস্থিতিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেই পাল্টাপাল্টি যুক্তির ঝড় বইছে। সান্ধ্য কোর্স নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সমালোচনা এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সুপারিশ সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কোর্স চলমান আছে, এমনকি নতুন বিষয়ে সান্ধ্য কোর্স খোলা হচ্ছে। ইংরেজি বিভাগে প্রথমবারের মতো সান্ধ্য কোর্স চালুর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ভর্তির বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ইংরেজি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভাগে সান্ধ্য কোর্স চালুর সিদ্ধান্ত বেশ আগের। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগ ইউজিসির পরামর্শের পরও সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি বন্ধ করেনি। প্রয়োজনের তাগিদেই বিভাগে ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্সের পাশাপাশি লিটারেচার (এমএ ইন ইংলিশ) কোর্স চালু করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

গত ১১ ডিসেম্বর ইউজিসি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স বন্ধসহ ১৩ দফা পরামর্শ দিয়ে চিঠি দেওয়ার পর ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্সের যৌক্তিকতা যাচাইয়ে শিক্ষা পরিষদে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সহ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা ১২ সদস্যের কমিটির প্রধান। কমিটি গঠনের এক মাস পর তাঁর কাছে বুধবার চিঠি পৌঁছেছে।

জানতে চাইলে আনন্দ কুমার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষা পরিষদে গঠিত কমিটির বিষয়ে বুধবার চিঠি পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় এখনো সান্ধ্য কোর্স চালু রাখা বা বন্ধ করার কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। তাই ইংরেজি বিভাগে এই কোর্স চালুর বিষয়ে নিয়মানুগ বাধা আছে বলে মনে হয় না।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ আছে ৫৮টি, ইনস্টিটিউট ৬টি। সান্ধ্য কোর্স চলছে ১৬টি বিভাগে এবং ৪টি ইনস্টিটিউটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ২০০ শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ৩০০ জন শিক্ষক এসব কোর্সে ক্লাস নেন। বেশির ভাগ সান্ধ্য কোর্স এক বা দুই বছরে ডিগ্রি দেয়।

সব কটি সান্ধ্য কোর্সে শিক্ষার্থী প্রায় ১ হাজার ৫০০। এক ও দুই বছরের এই শিক্ষাক্রম সম্পন্ন করতে একেকজনকে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ পর্যন্ত টাকা দিতে হয়। এ বাবদ আয়ের ২৫ শতাংশ যায় বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগারে, বাকি টাকার বড় অংশই পান শিক্ষকেরা।

অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের স্নাতক সম্মান শেষ করতে খরচ হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিভাগে বর্ষ এবং কিছু বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু আছে। এ ছাড়া বিভাগভেদে পরীক্ষার ফরম পূরণের ফি আলাদা হয়ে থাকে। তারপরও চার বছরের কোর্স শেষ করতে ৩০ হাজার টাকার কম খরচ হয়।

বিজ্ঞান অনুষদের অধিকর্তা অধ্যাপক এম খলিলুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের ভর্তুকি থাকায় নিয়মিত শিক্ষার্থীরা কম খরচে পড়াশোনা করতে পারেন। কিন্তু সান্ধ্য কোর্সে সেই সুযোগ না থাকায় খরচের অঙ্কটা বড় হয়ে যায়।

প্রশাসনিক ভবন সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালে ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে সান্ধ্য কোর্স শুরু হয়। ২০০৮ সালে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের চারটি বিভাগে সান্ধ্য কোর্স চালু হয়। এরপর ২০১৬ সালে অনুষদের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ এবং ২০১৯ সালে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে সান্ধ্য কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হয়।

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ছয়টি বিভাগে সান্ধ্য কোর্স চালু হয় ২০১৫ সালে। এক ও দুই বছর মেয়াদি কোর্সে শিক্ষার্থীদের ৯০ হাজার ও ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। আইন বিভাগে ২০১০ সাল থেকে সান্ধ্য এলএলএম কোর্স চলছে। এতে এক ও দুই বছরের কোর্সে ৯০ হাজার ও ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কোর্সগুলোতে ৬০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।

এ ছাড়া বিজ্ঞান অনুষদে গণিত এবং পরিসংখ্যান বিভাগ এবং প্রকৌশল অনুষদে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগে, বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ), শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাঙ্গুয়েজেজ ইনস্টিটিউটে সান্ধ্য কোর্স রয়েছে।

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধিকর্তা মো. ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বিক্রির অভিযোগ আছে। সেই তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সের মান ভালো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স বন্ধ হলে শিক্ষকেরা খণ্ডকালীন শিক্ষকতা এবং শিক্ষার্থীরা আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে পারেন।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক এস এম আবু বকর বলেন, ‘চাকরিজীবীরা তো আর জ্ঞান নিতে আসে না, তাদের জ্ঞান অর্জন শেষ। আর শিক্ষকেরা সত্যিই যদি জ্ঞানদান করতে চান, তাহলে আলাদা শিফট চালু করা যেতে পারে। কত শিক্ষার্থী তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় না, তারাও সেখানে পড়বে। যদিও তাতে কিছু শিক্ষকের উপার্জন কমে যাবে।’

সান্ধ্য কোর্স চালু থাকা বেশির ভাগ বিভাগের বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিয়মিত শিক্ষার্থীদের তুলনায় সান্ধ্য কোর্সে শিক্ষকেরা অধিক মনোযোগ দিচ্ছেন, শিক্ষার মানে ছাড় দিয়ে সনদ বিক্রি করছেন। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রয়োজনের বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে।

তবে সব অভিযোগ উড়িয়ে দেননি ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অধিকর্তা এম হুমায়ুন কবির। খাতা দেখা ও ফলাফলে ছাড় দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পেইড প্রোগ্রামে একটু লিবারেল হওয়ার প্রবণতা সারা বিশ্বেই আছে। আমাদের এখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অবকাঠামো—তিন দিকেই দুর্বলতা আছে। তবে সান্ধ্য কোর্সের শিক্ষার্থীদের মানসম্মত ডিগ্রি দেওয়ার চেষ্টা আমরা করে থাকি।’

২০১৪ সালে বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্সের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী আবদুল মজিদ বলেন, ‘আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম বাণিজ্যিক কোর্সের বিরুদ্ধে। সেটা সন্ধ্যায় না দুপুরে নেওয়া হচ্ছে, তা ব্যাপার না। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষায় তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়েছে। অথচ সান্ধ্য কোর্সে স্রেফ টাকার জোরে ভর্তি হয়ে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নিচ্ছে। সব শিক্ষার্থী যেন একই রকম ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে একই খরচে পড়াশোনার সুযোগ পায়, সেটাই আমাদের চাওয়া।’

সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই কর্মজীবী। তাঁরা কর্মস্থলে পদোন্নতিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য এগিয়ে থাকতে সান্ধ্য কোর্সে ভর্তি হন। কিছু শিক্ষার্থী অবশ্য কোথাও কর্মরত নন। তাঁদের অনেকেই কম পরিচিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পড়েছেন। নিজেদের অধিকতর যোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁরা ডিগ্রি নিতে চান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে সান্ধ্য কোর্স করছেন মো. মিজানুর রহমান। দুই বছর মেয়াদি কোর্সের জন্য তাঁকে এক লাখ টাকা ফি দিতে হয়েছে। মিজানুর রহমান বলেন, ‘এখানে যাঁরা কোর্স করেন, তাঁদের বেশির ভাগই কর্মজীবী। তাঁদের সবার নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। তাঁরা কর্মস্থলে সুবিধা পান। তবে তাঁর মতে, কোর্স ফি একটু ব্যয়বহুল।’

সান্ধ্য কোর্স প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে। চলছে যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি। ইউজিসি চিঠি দেওয়ার ছয় সপ্তাহ পরও এ বিষয়ে গঠিত কমিটির কাজ শুরু না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মলয় ভৌমিক বলেন, ‘পড়াশোনার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু শিক্ষার মূল চেতনাটা এখানে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, সেটি দেখার বিষয়। সান্ধ্য কোর্সের নামে যা হচ্ছে, তা একেবারেই ব্যবসা। এতে শিক্ষকদের আয়বৈষম্য হচ্ছে। বাজারে কদর নেই এমন বিভাগেও সান্ধ্য কোর্স খোলা হচ্ছে, এসব বিভাগ শিক্ষার্থী পাচ্ছে না।’ প্রয়োজনে একই সিলেবাসে ডাবল শিফট চালু, শিক্ষকদের ওভারটাইম দেওয়া এবং একই সিলেবাসে সমমানের ডিগ্রি দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।