শুরু কী করে করি

>
গড়িমসি না করে কোনো কাজ শুরু করার সংকেত পাঠিয়ে দিতে হবে মস্তিষ্কে, কেননা সেখানেই লুকিয়ে থাকে আমাদের উদ্যম। ছবি: প্র স্টুডিও
গড়িমসি না করে কোনো কাজ শুরু করার সংকেত পাঠিয়ে দিতে হবে মস্তিষ্কে, কেননা সেখানেই লুকিয়ে থাকে আমাদের উদ্যম। ছবি: প্র স্টুডিও
বিল গেটস বলেছিলেন, যেকোনো উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন হলো ‘শুরু করা’। পড়ালেখা, চাকরি, ব্যবসা—নানা ক্ষেত্রেই আমরা মনে মনে বিভিন্ন পরিকল্পনা করি, নতুন কোনো আইডিয়া ভাবি, কিন্তু শুরুটাই করা হয় না। কেন আমরা কোনো কাজ শুরু করতে ভয় পাই? কীভাবে শুরু করতে হয়? লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রোগ্রামিং শেখানোর প্রতিষ্ঠান প্রোগ্রামিং হিরোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ঝংকার মাহবুব

শুরুর তিন শত্রু

তুমি নিজেই জানো, কাজটা আজই শুরু করে দেওয়া উচিত। কীভাবে করতে হবে, তা-ও তুমি জানো। কাজটা করার ধারণা, জ্ঞান, দক্ষতা, সময় তোমার গতকাল ছিল, আজ আছে, কালও থাকবে। যদি গতকাল আর আজ তুমি না করে থাকো, তাহলে কালও তুমি করবে না। প্রশ্ন হলো, কেন তুমি কাজটা করছ না?

এর কারণ আসলে তিনটা। এক, তুমি নিশ্চিত নও যে কাজটা শেষ করতে পারবে কি না। দুই, অন্যদের চেয়েও ভালো করতে পারবে কি না, সেই আত্মবিশ্বাস তোমার নেই। তিন, এখন যে অবস্থানে আছ, তার চেয়ে ভালো কোনো অবস্থানে যাবে কি না, সে ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত নও। সমস্যা যদি তুমি জানো, তাহলে সমাধান করা নিশ্চয়ই সহজ। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাজটা সব সময়ই অসম্ভব মনে হয়।’ আর ডিজনি ওয়ার্ল্ডের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াল্ট ডিজনির একটা উক্তিও জানিয়ে রাখি, ‘সব স্বপ্নই সত্য হতে পারে, যদি সেটা তাড়া করার মতো দৃঢ়তা থাকে।’

ছোট থেকে বড়

 ‘ওরেব্বাবা! কত পড়া বাকি!’—এভাবেই বেশির ভাগ সময় পরীক্ষার আগে সিলেবাসের দিকে তাকিয়ে আমরা ঘাবড়ে যাই। শুধু পড়ালেখা নয়, যেকোনো কাজই বড় পরিসরে দেখলে কাজটা কঠিন মনে হয়। কিন্তু তুমি যদি এই কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ফেলো, তাহলেই কিন্তু সেটা অনেক সহজ।

তোমাকে কেউ যদি বলে, এক মণ চালের ভাত খেতে হবে, তুমি ঘাবড়ে যাবে। কিন্তু যদি বলে, না, এক কেজি চালের ভাত খেতে হবে—তা–ও হয়তো তুমি দুশ্চিন্তায় পড়বে। এরপর যদি বলে, এক কেজি চালের ভাতই খেতে হবে, কিন্তু দুই দিনে, তাহলে নিশ্চয়ই তোমার কাছে কাজটা আর অসম্ভব মনে হবে না। চীনা একটা প্রবাদ আছে—হাজার মাইল পথচলা শুরু হয় এক কদম পা ফেলা থেকে।

অতএব যেকোনো অ্যাসাইনমেন্ট, কোনো রিপোর্ট তৈরি, দক্ষতা আয়ত্ত করা, নিজের কোনো অভ্যাস পরিবর্তন, চাকরি বদল...যা-ই হোক না কেন, পুরো কাজটা নিয়ে একসঙ্গে ভাবতে যেয়ো না। বরং ছোট একটা অংশ খুঁজে বের করো। এই মুহূর্তে কোন অংশটা নিয়ে তুমি কাজ করতে পারো, সেটা বের করে তৎক্ষণাৎ শুরু করে দাও।

কোনো বই পড়ে শেষ করার ডেডলাইন যদি এক মাস পর হয়, সেটাকে মস্তিষ্ক থেকে মুছে ফেলো। তারপর নিজেকে বলো, তোমার আজ প্রথম অধ্যায়টা শেষ করার দিন। পুরো বইয়ের পরীক্ষা যদি এক মাস পর হয়, তিন দিন পর তুমি শুধু প্রথম অধ্যায়ের ওপর নিজেই নিজের একটা পরীক্ষা নাও। সেই পরীক্ষার জন্য আগে প্রস্তুতি নাও।

ছবি: প্র স্টুডিও
ছবি: প্র স্টুডিও

নতুন একটা ব্যবসা শুরু করতে চাও? ১০০টি পণ্য বিক্রি করার দরকার নেই। প্রথমে ১টি বিক্রি করো। সেটা শেষ হলে আরও ৩টি বিক্রি করো। বড় ক্লায়েন্ট ধরতে হবে। আগে ছোট ছোট ক্লায়েন্ট ধরার চর্চা করো। ১০ পাতার ওয়েবসাইট বানাতে হবে। এক পাতা বানাও। ১২০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট লিখতে হবে। আজ শুধু শুরুটা লেখো। কী লিখবে মাথায় না এলে, কোনো বই থেকে দেখে দেখে হলেও টাইপ করো। শুরুটা হোক।

মোবাইল ভয়ংকর

তুমি কি মুঠোফানে আসক্ত? হয়তো দুদিকে মাথা নেড়ে বলবে—না তো! সে ক্ষেত্রে একটা তথ্য জানিয়ে রাখি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এক্সেল ও কোয়ালট্রিকসের এক জরিপে জানা গেছে, এ সময়ের তরুণেরা প্রতিদিন গড়ে ১৫০ বারের বেশি স্মার্টফোন চেক করে (এমন আরও জরিপের তথ্য দেখতে পারো এই ওয়েবসাইটে: qualtrics. com/millennials/)। অর্থাৎ, কেউ যদি দিনে ৮ ঘণ্টা ঘুমায়, তাহলে প্রতি ঘণ্টায় ১০ বার, মানে ৬ মিনিট পরপর মোবাইল দেখে। ধরে নিচ্ছি, তুমি এই তরুণদের মতো নও। তাহলে নিজেই নিজেকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দাও—এক দিনের জন্য মোবাইল বন্ধ রাখো। স্রেফ এক দিন। এই একটা দিন নিজেকে আরও উন্নত করতে কাজে লাগাও।

মুঠোফান হলো মনোযোগ নষ্ট করার সবচেয়ে মোক্ষম যন্ত্র। তুমি হয়তো খুব মন দিয়ে পড়ছ, মেসেঞ্জারের একটা ‘টুং’ শব্দ তোমার পুরো মনোযোগ কেড়ে নিতে পারে। এক মিনিট বিরতি নিতে গিয়ে দেখবে এক ঘণ্টা হারিয়ে গেছে। ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্টের খোঁজ নিতে অনলাইনে ঢুকে তুমি হয়তো খেলার খবর, সিনেমার খবর, ভাইরাল নিউজ দিয়ে মাথা ভর্তি করে ফেলবে। তোমার মনোযোগ, সময় কেড়ে নিয়ে হাতে ধরিয়ে দেবে হতাশা।

গড়িমসি করি কেন

আমাদের সবার মস্তিষ্কের গভীরে দুই পাশে অ্যামিগডালা (amygdala) নামে দুইগুচ্ছ নিউরন আছে। এদের আকৃতি অনেকটা বাদামের মতো। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে—আমাদের আবেগ, ভয়, উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করে এই অ্যামিগডালা নামের নিউরনগুলো। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো একটি নির্দিষ্ট কাজ না করে গড়িমসি করতে থাকলে আমাদের মস্তিষ্কের অ্যামিগডালাতে প্রভাব ফেলে। আর নিয়মিত গড়িমসি (ইংরেজিতে বলে প্রোকাস্টিনেশন) করতে থাকলে ধীরে ধীরে খারাপ লাগার পরিমাণ বাড়তেই থাকে। সেটা এক সময় শংকা, উদ্বেগ, ভয়, হতাশার জন্ম দেয়।

এরপর দেখা যায় ভয় আর শংকা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই গড়িমসির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। এভাবেই একজন পড়ে যায় প্রোকাস্টিনেশনের দুষ্টু চক্রে। তাই দুষ্টু চক্র ভেঙে ফেলার জন্য অনেকে পরামর্শ দেন— যে কাজটা করা দরকার তা স্রেফ দুই ঘণ্টার জন্য করে ফেলো। গড়িমসির শেকলটা ভাঙো। কম কম করে হলেও প্রতিদিন কাজটা করতে থাকো। দেখবে ধীরে ধীরে ভয় ও উদ্বেগ হারিয়ে যাবে।

সূর্যের মতো পোড়ো

নানা কারণের বাইরেও অনেকের পকেটে আরও একটা বড় কারণ থেকে যায়। তা হলো, ‘আমার ভাল্লাগে না’, ‘আমার মন চাইছে না’ কিংবা ‘আমার মুড আসছে না’।

ভেবে দেখো, তুমি হয়তো তিন বছর ধরে ভাবছ শরীরচর্চা শুরু করবে। প্রতি দিন দশটা পুশ আপ দেবে। কিন্তু শুরু আর করা হচ্ছে না। এখন হঠাৎ যদি বাড়িতে কোনো ডাকাত ঢুকে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলে, দশটা পুশ আপ দিতে হবে, তুমি কিন্তু দশটার জায়গার বিশটা দিয়ে ফেলবে। এটাই মুশকিল। যথেষ্ট ‘পুশ’ (ধাক্কা) না পেলে আমাদের ‘পুশ আপ’ দেওয়া হয় না। অতএব নিজেই নিজেকে ‘পুশ’ করো।

দিন শেষে জীবনের সবকিছুই নির্ভর করে অগ্রাধিকারের ওপর। তুমি এ মুহূর্তে কোন বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছ? সেটাই তুমি করবে। কেউ তোমাকে আটকে রাখতে পারবে না। অতএব নিজেই নিজের অগ্রাধিকারের জায়গাটা ঠিক করো। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘তুমি যদি সূর্যের মতো আলো ছড়াতে চাও, আগে সূর্যের মতো পোড়ো।’