উচ্চমাধ্যমিকে আইসিটি শিক্ষা: ভুল ও বিভ্রান্তির গোলকধাঁধা

বইয়ের নির্দেশনামতো নির্দিষ্ট সফটওয়্যারে প্রোগ্রাম লিখলে বাংলাদেশ শব্দটি ১০ বার দেখানোর কথা, কিন্তু দেখায় ১২ বার। কম্পিউটারে দুটি সংখ্যার গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়ক (গসাগু) নির্ণয়ের প্রোগ্রাম লিখলে ভুল ফল আসে। এ রকম হাজারো ভুল আর বিভ্রান্তিতে ভরা পাঠ্যবই পড়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির (আইসিটি) ব্যাকরণ শিখছে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। ভুলভাল শিখেই তারা পরীক্ষা দিচ্ছে।

আইসিটি বিষয়ে বাজারে এখন বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থাগুলোর ১৯টি পাঠ্যবই আছে। একটি বইয়ের প্রোগ্রামিং ভাষা অধ্যায়ের শিরোনামে বলা আছে, এটা ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যাগুলোর যোগফল নির্ণয়ের প্রোগ্রাম। কিন্তু প্রোগ্রামটি চালালে যোগফলের বদলে আসছে গুণফল। আরেকটি বইয়ের শিরোনামে লেখা বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয়, অথচ প্রোগ্রামটি হচ্ছে বর্গের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের। অধিবর্ষ বা লিপ ইয়ার নির্ণয়ের প্রোগ্রামটি চলেই না।

আইসিটির আরেকটি বইয়ের উদাহরণে ওয়েবপেজ লেখার এইচটিএমএল (হাইপারটেক্সট মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজ) কোডে আছে, পটভূমির রং (ব্যাকগ্রাউন্ড কালার) সবুজ। অথচ পাশে ফলাফল বা আউটপুটের পাতার ছবিতে রংটি নীল। একইভাবে অন্যত্র লাল হয়ে গেছে সবুজ। আবার কোডের টাইটেলে আছে ‘স্টুডেন্ট ফোরাম’, কিন্তু ফলাফলের ছবিতে দেখাচ্ছে ‘সিস্টেক ডিজিটাল’। এখানেই শেষ নয়, কিছু বিষয়ে একেক পাঠ্যবই একেক রকম তথ্য দিচ্ছে, যেটা শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে।

উচ্চমাধ্যমিকের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) শুধু বাংলা ও ইংরেজি বই প্রকাশ করে। অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে এনসিটিবি শর্ত বেঁধে দিয়ে বিভিন্ন প্রকাশনীর পাণ্ডুলিপি নেয়। সেগুলো মূল্যায়ন করে পাঠ্যবই হিসেবে অনুমোদন দেয়। গতকাল প্রকাশিত এ ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে যেমনটা দেখা গেছে, প্রতিটি বই অনুমোদনের শর্ত ভেঙে বেরোচ্ছে। বইগুলো ঢাউস, কঠিন এবং বোর্ড-নির্ধারিত মূল্যের কয়েক গুণ বেশি।

এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলামের মতে, বইয়ে ভুলভাল থাকার মূল কারণ লেখকদের নিষ্ঠার অভাব। প্রথম আলোকে তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত কাজের চাপে এনসিটিবিও মান নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে পারছে না।

>

প্রতিটি পাঠ্যবইয়ে চিহ্ন, যুক্তি ও ছাপার ভুলের ছড়াছড়ি। বইয়ে বইয়ে তথ্যের গরমিল। এক যুগের পুরোনো সফটওয়্যার উপযোগী কোড পাঠ্যবইয়ে।

আইসিটির বইগুলোর লেখকেরা সিএসই বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী, কেউবা পিএইচডি করেছেন। এদিকে এনসিটিবি বইগুলো মূল্যায়নের জন্য সাতজন কলেজশিক্ষকের যে প্যানেল করেছিল, তাঁদের একজন ছাড়া অন্য কেউ এ বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা করেননি। তবে তাঁরা যে বই মূল্যায়ন করেছেন, চালু আছে তার অবৈধ বর্ধিত সংস্করণ।

ভুল চিহ্ন, ভুল যুক্তি
বাংলা, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার মতো আইসিটির বিষয়বস্তু হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির ভাষা। এর রয়েছে নিজস্ব ব্যাকরণ আর চিহ্ন দিয়ে গড়া সংকেত বা কোড। প্রতিটি সংকেতের রয়েছে আলাদা অর্থ। প্রচলিত আইসিটি বইগুলোতে মোটাদাগে দুই ধরনের ভুল আছে। চিহ্নের ভুল ও যুক্তির ভুল। ছাপার ভুল তো আছেই।

সংকেতে ভুল চিহ্ন বসতে পারে, আবার চিহ্নের বিন্যাস বা সিনট্যাক্সে ভুল হতে পারে। চিহ্ন বা সংকেতে ভুল করলে কম্পিউটারে প্রোগ্রাম চলে না। আরেক ধরনের ভুল হলো যুক্তির ভুল। অর্থাৎ, কাঙ্ক্ষিত ফল দেওয়ার মতো যুক্তিসংগতভাবে প্রোগ্রামটি লেখা হয়নি। যুক্তির ভুল করলে কম্পিউটারে প্রোগ্রাম চলে, তবে আউটপুট বা ফল ভুল আসে।

তথ্যপ্রযুক্তির প্রতিটি ক্ষেত্রেই মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। বিভিন্ন প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা শেখা সহজ হয়ে যায় সি প্রোগ্রামিং আয়ত্তে থাকলে। আইসিটি বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু সি প্রোগ্রামিং। অধ্যায়টি পড়লে ভবিষ্যতে আইসিটি বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনার ভিত্তি পাকা হওয়ার কথা। অথচ অধিকাংশ পাঠ্যবইয়ে অধ্যায়টিতে সবচেয়ে বেশি ভুল আছে।

ভুলের আরও কিছু নমুনা; সাধারণত সংকেতে একেকটি লাইনের শেষে সেমিকোলন (;) দিতে হয়। আবার একই কাজ বারবার করতে হলে প্রোগ্রামে বন্ধনীর মধ্যে শর্ত উল্লেখ করে সংকেত ব্যবহার করা হয়। একে বলে লুপ। ফর (for) ও হোয়াইল (while) নির্দেশনা দিয়ে শুরু হওয়া লুপের লাইনে সেমিকোলন দেওয়া যায় না। সেটা ভুল। অক্ষরপত্র প্রকাশনীর বইয়ে এমন ভুল চোখে পড়েছে। ইফ (if) শর্ত দেওয়া লাইনের পরও সেমিকোলন দিলে ভুল হবে। এমন ভুল দেখা গেছে সিসটেক পাবলিকেশন্সের বইয়ে।

প্রোগ্রামের ধাপগুলো প্রবাহচিত্র বা ফ্লো-চার্ট এঁকে দেখানো হয়। এ ছাড়া ধাপগুলোর বর্ণনাও থাকে, যাকে বলে অ্যালগরিদম। লেকচার পাবলিকেশন, অক্ষরপত্র প্রকাশনী, সিসটেক পাবলিকেশনস, হাসান বুক হাউসসহ অধিকাংশ প্রকাশনীর বইয়ে দুটি পূর্ণসংখ্যার গসাগু নির্ণয়ের প্রবাহচিত্র ও অ্যালগরিদম ভুল লেখা আছে। এর প্রোগ্রামের নির্দেশনাতেও ভুল আছে। তিন ক্ষেত্রেই ভুলটা যুক্তির। সফটওয়্যারে প্রোগ্রামটি লিখলে তা ভুল ফল দেয়।

সিসটেক পাবলিকেশনের বইয়ে অধিবর্ষ নির্ণয়ের প্রোগ্রামে চিহ্নের ভুল আছে। বিভিন্ন বইয়েই এমন উদাহরণ আছে, যেখানে প্রোগ্রামের শিরোনাম এক, অ্যালগরিদম অন্য, আবার হয়তো প্রবাহচিত্রও ভিন্ন। একটি বাদে বাজারের সব বইয়ে সি প্রোগ্রামিং অধ্যায়ে কোনো না কোনো ভুল আছে।

ইন্টারনেটে যেসব ওয়েবসাইট আছে, এর প্রতিটি একাধিক ওয়েবপাতার সমষ্টি। ওয়েবপাতা তৈরির মৌলিক ভাষা হচ্ছে হাইপারটেক্সট মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজ (এইচটিএমএল)। আইসিটি বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় এ ভাষা শেখানোর জন্য। অধ্যায়টির নাম ওয়েব ডিজাইন পরিচিতি ও এইচটিএমএল। এখানে ওয়েবপাতার কোডে পটভূমি বা লেখার ফন্টের রঙের যে বিবরণ আছে, পাশে ওয়েবপাতাটির ছবির সঙ্গে তা মেলে না। অন্তত ছয়টি বইয়ে এমনটা দেখা গেছে।

হাসান বুক হাউসের বইয়ে কয়েকটি উদাহরণে এইচটিএমএলের কোডে সমাপনী চিহ্ন নেই। ফলে ওই কোড দিয়ে কাঙ্ক্ষিত পাতা তৈরি করা যাবে না। কোডের শিরোনাম আর ফলাফল বা আউটপুটের শিরোনামে গরমিলের অনেক উদাহরণ আছে। বাজারের সব বইয়েই এ অধ্যায়ের কোডগুলোতে কোনো না কোনো ভুল আছে।

ওপরে যেমন দেখানো হয়েছে, চতুর্থ আর পঞ্চম অধ্যায়েই সবচেয়ে বেশি ভুল। তবে অন্য অধ্যায়গুলোতেও যথেষ্ট ভুল আছে। তৃতীয় অধ্যায়ে, যেমন সার্কিট আঁকাসহ যুক্তির ভুল আছে অনেক বইয়ে।

রাজন সাহা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগে চতুর্থ বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়াশোনা করছেন। তিনি বিভাগে ভালো প্রোগ্রামার হিসেবে পরিচিত। প্রথম আলোকে রাজন বলেন, ‘এইচএসসিতে পড়ার সময় বইয়ের কোডগুলো করে দেখতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি। এখন বুঝতে পারছি, আদতে অনেক কোডই ভুল ছিল।’

নানা মুনির নানা পথ
‘অনুমোদিত’ ছাপ্পা মারা পাঠ্যবই আছে ১৯টি, কলেজগুলো তার মধ্য থেকে বেছে নেয়। কিছু বিষয়ে একেক বই একেক তথ্য দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। বইগুলোর ছয় অধ্যায়ের প্রতিটিতে এ রকম বিভ্রান্তির উপাদান ছড়িয়ে আছে।

উপাত্তভান্ডারে একটি সারণিভুক্ত উপাত্তের সঙ্গে অন্যান্য সারণিভুক্ত উপাত্তের সম্পর্ককে ডেটাবেইস রিলেশন বলে। লেকচার পাবলিকেশনের আইসিটি বইয়ে ষষ্ঠ অধ্যায়ে আছে, ডেটাবেইস রিলেশনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। হাসান বুক হাউসের বইয়ে আছে, এ সম্পর্ক তিন ধরনের হয়। কিন্তু সিসটেক পাবলিকেশনের বই বলছে, ডেটাবেইস রিলেশন চার রকম।

সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের শিক্ষার্থী সাজিদ সাফাওয়াত হোসেন একেক বইয়ে একেক তথ্য বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পরীক্ষায় এমন প্রশ্ন আসলে আমরা কীভাবে বুঝব প্রশ্নটি কোন বই থেকে করা হয়েছে? আমরা কি জ্যোতিষী যে গণনা করে বলব, অমুক বই থেকে প্রশ্ন করেছে, তাই তিন প্রকার? তমুক বই থেকে প্রশ্ন করেছে, তাই চার প্রকার?’

এমন বিভ্রান্তির কথা মেনে নিচ্ছেন এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক সন্তোষ কুমার ঢালী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনামতো আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এনসিটিবি নিজে বই প্রকাশ করবে। তাঁর আশা, তখন বিভ্রান্তি দূর হবে।

মান্ধাতার আমলে
আজ থেকে ১০ বছর আগে সি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কোড লেখার জন্য যে সফটওয়্যার চলত, তার নাম টার্বু সি। সেটাতে কাজ সম্পাদনের প্রক্রিয়া বা ফাংশনও ছিল ওই সফটওয়্যারের সঙ্গে মানানসই। এখন প্রোগ্রামাররা কোডব্লকসের মতো শক্তিশালী সফটওয়্যার ব্যবহার করেন। অথচ আইসিটি বইয়ে টার্বু সি সফটওয়্যার মাথায় রেখে প্রোগ্রাম লেখা হয়েছে।

বাংলা সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকার সফটওয়্যার প্রকৌশলী ও দলনেতা হিসেবে কাজ করছেন মাহবুবুর রব তালহা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আইসিটি বইগুলো প্রোগ্রামিং করার জন্য যেসব সফটওয়্যার অনুসরণ করেছে, সেগুলো কমবেশি এক যুগের পুরোনো। চলতি সফটওয়্যারে এসব বইয়ের অনেক প্রোগ্রাম চলে না। আবার কিছু সংকেত না দিলেও চলে।

প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়া, ভুল আর বিভ্রান্তিতে ভরা এই বইগুলো পড়ানোর জন্য উপযুক্ত শিক্ষক থাকলে শিক্ষার্থীরা তবু হয়তো রক্ষা পেত; কিন্তু এ বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব প্রকট।