এখন আর বৃত্তি চাই না

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের ছাত্র দীপক চন্দ্র বর্মন। ছবি: খালেদ সরকার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের ছাত্র দীপক চন্দ্র বর্মন। ছবি: খালেদ সরকার

কয়েক দিন ধরেই ফেসবুকে চোখে পড়ছে একটি আবেদনপত্রের ছবি। বিষয়ের জায়গায় লেখা আছে, ‘মাসিক বৃত্তি বাতিলের জন্য অনুরোধ প্রসঙ্গে’। আবেদনপত্রের লেখক দীপক চন্দ্র বর্মন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি লিখেছেন, ‘আমার বাবা একজন ইটভাটার শ্রমিক। তাঁর সামান্য আয়ে ঢাকায় আমার লেখাপড়ার খরচ নির্বাহ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ত। এমন অবস্থায় আপনার ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া বৃত্তি আমার লেখাপড়ার পথকে সুগম করেছে। এই বৃত্তি না পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরেই আমার ছন্দময় শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়ত। বর্তমানে আমি ঢাকা শহরে নিজের খরচ নিজেই নির্বাহ করার সামর্থ্য অর্জন করেছি। দু-একটা টিউশনি করছি। তাই আমি মনে করি, এখন মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে বৃত্তি না পেলেও আমার লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যেতে পারব। তাই আমার বৃত্তি বাতিল করে দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’

স্বাভাবিকভাবেই লাইক-শেয়ার-কমেন্টের মধ্য দিয়ে এই ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যাঁকে নিয়ে এত তুলকালাম, সেই দীপক চন্দ্র বর্মনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম আমরা। শুনেছি তাঁর গল্প। দীপকের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের কামাতপাড়া গ্রামে। বাবা ইটভাটার শ্রমিক। মা গৃহিণী। বাড়িতে মা–বাবা আর ছোট দুই বোন ছাড়াও আছেন বৃদ্ধ দাদি। তাঁর গ্রামের কেউ কোনো দিন পড়াশোনার জন্য শহর পাড়ি দেননি। বড়জোর উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন কেউ কেউ।

ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল দীপকের। তা–ই দেখে গ্রামের লোক ফোড়ন কেটে বলতেন, ‘অত লেখাপড়া করে কাজ নাই। চাকরি করতে ঘুষ লাগে। ঘুষের টাকা পাবি কোথায়? তারচেয়ে বাবার সঙ্গে কাজে যা।’ এসব কথায় এতটুকুও দমে যাননি লক্ষ্যে অটুট এই অদম্য মেধাবী। ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আগে কোনো দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না দেখলে কী হবে, মনে মনে কল্পনা করে নিয়েছিলেন। আর ঠিক করেছিলেন, এখানেই পড়বেন। ঢাকার একটি কোচিং সেন্টার ঠাকুরগাঁও জেলাসদরে গিয়ে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের একটা পরীক্ষা নিয়েছিল। সেখানে ভালো ফল করায় তারাই দীপকের ঢাকা শহরে আসা, থাকা, খাওয়া ও কোচিংয়ের সব ব্যবস্থা করে দেয়।

তারপরের গল্পটা কিছুটা সরলরৈখিক। ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর দীপকের ইচ্ছা ছিল গণিত বা পদার্থবিজ্ঞানে পড়বেন, কিন্তু বড় ভাইদের পরামর্শে ভর্তি হন ফার্মাসি বিভাগে। জিপিএ–৫ ছিল না বলে কোনো ব্যাংকের বৃত্তির জন্য আবেদন করতে পারেননি। এগিয়ে এসেছিল মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। ভর্তির ১৮ হাজার টাকাও দিয়েছিল এই সংস্থা। আর প্রতি মাসে তারা সাড়ে তিন হাজার টাকা করে বৃত্তি দিত দীপককে। তা দিয়েই চলেছে স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীপকের প্রথম বর্ষ।

দ্বিতীয় বর্ষে উঠে হলের বড় ভাইদের সহযোগিতায় দুটো টিউশনি পান। সেটি নিশ্চিত করে প্রথমেই এই ফাউন্ডেশনের প্রধান বরাবর মেইল পাঠিয়ে বৃত্তি বাতিল করেন। জানুয়ারি মাস থেকে আর বৃত্তি পাবেন না দীপক। চলবেন টিউশনির টাকায়। জানালেন, তাঁর ছাত্ররা নাকি তাঁর কাছে পড়তে খুব ভালোবাসে। জানতে চেয়েছিলাম, বৃত্তি তো কোনো অনুগ্রহ নয়, তবে এই ফিরিয়ে দেওয়া কেন? দীপকের উত্তরটা খুব সুন্দর। ‘আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। কারও ওপর বা কোনো কিছুর ওপর নির্ভরশীল হতে চাই না। আর আমার এই বৃত্তির টাকা নিশ্চয়ই আমার মতো অন্য কারও দুঃসময়ের সহায় হবে। এখন আমার চেয়ে তার হয়তো টাকাটা বেশি দরকার।’

দীপকের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ হলো মুঠোফোনে। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটা খুব সহজ–সরল আর সৎ। ওকে আপনারা দেখে রাখবেন। আমি গরিব মানুষ। জমি–জায়গা কিচ্ছু নাই। বাবা–মায়ের মন জানে, ছেলে দূরে থাকলে কেমন লাগে। একটাই ছেলে আমার। কত দিন বাড়িতে আসে না। পৌষ-পার্বণ গেল, ছেলেরে পিঠা খাওয়াইতে পারলাম না।’ মা জানালেন, অভাবের সংসারে তিনি চেয়েছিলেন বৃত্তির টাকা দিয়ে দীপকের পড়ালেখার খরচ চলুক। আর টিউশনির টাকা ছেলে বাড়িতে পাঠাক। যেন দুই বোনের লেখাপড়া আর সংসারের খরচ চালানো সহজ হয়। দীপক মাকে জানিয়েছেন, তাঁর উপার্জনের টাকা দিয়েই তিনি পড়ালেখা, বোনদের সহযোগিতা, সব করবেন। নিজের, বোনদের আর সংসারের দায়িত্ব তুলে নেবেন নিজের ছোট্ট অথচ শক্ত কাঁধে।

দীপকের এক বোন পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। আর সবার ছোটটা সপ্তম শ্রেণিতে। ঢাকায় এসে এই দুই বোনের কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তাঁর। বোনদের কথা বলার সময় চকচক করে উঠল দীপকের চোখ। বললেন, ছোট বোনটা নাকি লেখাপড়ায় তাঁর চেয়েও ভালো। তার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা। বোনেরা মাঝেমধ্যে দীপককে ফোন করে। ঘুরেফিরে একটা কথাই বলে, ‘দাদা, বাড়ি আসবা কবে?’ বোনদের দেখতে দীপকেরও মন কেমন কেমন করে।

পড়াশোনা শেষ করে কী করতে চান? দীপক চন্দ্র বর্মনের উত্তরটা সহজ, ‘মানুষের কাছাকাছি থেকে এমন কিছু করতে চাই, যা মানুষের কাজে লাগে। আমার মাধ্যমে যেন মানুষের উপকার হয়।’