উচ্চশিক্ষায় সমন্বিত ভর্তি: ২৮ উপাচার্য একমত, অনাগ্রহ ঢাবি-বুয়েটের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ চার–পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাগ্রহের মধ্যে দেশের ২৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা গতকাল মঙ্গলবার সভা করে আসন্ন শিক্ষাবর্ষ (২০২০-২১) থেকেই সমন্বিত বা কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন। তাঁদের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে অনলাইনে ভর্তির আবেদন নেওয়া হবে। আর ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করা হবে নভেম্বরের মধ্যে। এই পরীক্ষার নাম হবে ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা’।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নে হবে এই পরীক্ষা। বর্তমানে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুনির্বাচনী প্রশ্নে (এমসিকিউ) পরীক্ষা হয়। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নগুলো করা হবে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যসূচির আলোকে। বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক শাখার শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা তিনটি পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হলেও এই বিষয়টি আরও আলোচনার ভিত্তিতে ঠিক হবে।

 রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভায় উপস্থিত হয়ে উপাচার্যরা এসব সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য এই সভায় উপস্থিত ২৮ জন উপাচার্যের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিষদের (একাডেমিক কাউন্সিল) সভা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় এই পদ্ধতিতে রাজি না হলে তাঁদের পক্ষে এই প্রক্রিয়ায় যাওয়া কঠিন হবে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

গতকালের সভায় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে আগে থেকেই অনাগ্রহ থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাবিষয়ক যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিষদ ও ডিনস কমিটির। তারা যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেই সিদ্ধান্তের আলোকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হবে।

বর্তমানে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। যদিও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সরাসরি শিক্ষার্থী ভর্তি করে না। ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এগুলোতে প্রতিবছর প্রায় ৫৫ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হন। এ জন্য ভর্তি পরীক্ষায় কয়েক লাখ শিক্ষার্থী অংশ নেন। ইউজিসির চেষ্টা হলো দোদুল্যমান থাকা স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটকেও এই প্রক্রিয়ায় রাজি করানো। এ জন্য আজ বুধবার ইউজিসিতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। চেষ্টার পরেও যদি ‘স্বাতন্ত্র্যের’ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রক্রিয়ায় না আসে, তাহলে তাদের বাদ দিয়েই আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে।

ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের দুর্ভোগ কমাতে কয়েক বছর ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত বা গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় তাতে রাজি হয় না। অভিযোগ রয়েছে, মূলত ভর্তির ফরম বিক্রি বাবদ বিরাট অঙ্কের টাকার আয় থেকে শিক্ষকেরা বঞ্চিত হওয়ার ভয়েই এই পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজি হতে চায় না।

 এই প্রক্রিয়ায় ভর্তি পরীক্ষা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একাধিকবার আহ্বান জানিয়েছেন। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে গত বছর (চলতি শিক্ষাবর্ষ) সাতটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এরপর গত ২৩ জানুয়ারি ইউজিসিতে অনুষ্ঠিত এক সভায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর থেকে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাগ্রহ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রক্রিয়া এসেছে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহর পক্ষ থেকে। এই অনাগ্রহের বিষয়ে তিনি গত সোমবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের সিদ্ধান্তহীনতার জন্য গোটা জাতির আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থাকতে পারে না। কারও ‘ইগো’ যেন অন্যদের প্রভাবিত করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।

ইউজিসির সূত্রমতে, নতুন পদ্ধতিতে দুই থেকে তিন দিনে এই ভর্তি পরীক্ষা হবে। কেন্দ্রগুলো হবে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীদের পছন্দ অনুযায়ী কেন্দ্র ঠিক হবে। তবে কোনো কেন্দ্রে (বিশ্ববিদ্যালয়) ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি পছন্দ এলে মেধার ভিত্তিতে (এসএসসি ও এইচএসসির ফল) কেন্দ্র ঠিক করা হবে। মেধার ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে তাঁর পছন্দক্রম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের গতকালের সভায় ভর্তি পরীক্ষাসংক্রান্ত আরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহাম্মদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সভায় ২৮ জন উপাচার্যের সবাই কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে একমত। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি না আসে, তাহলে তাদের ছাড়াই বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই প্রক্রিয়ায় ভর্তি পরীক্ষা নেবে।

সভায় উপাচার্যদের মধ্যে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আবদুস সোবহান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-অর-রশিদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহাম্মদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন উর রশিদ আসকারী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান প্রমুখ।