ভবিষ্যৎ স্থপতিদের বর্তমান প্রকল্প

পদ্মপুকুরের এই স্থাপনা এখন শিক্ষার্থীদের প্রিয় আড্ডাস্থল। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
পদ্মপুকুরের এই স্থাপনা এখন শিক্ষার্থীদের প্রিয় আড্ডাস্থল। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

ছোট ছোট টিলা আর ছায়াঘেরা পরিবেশের জন্য ভালোবেসে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে (চুয়েট) অনেকে ‘গ্রিন হ্যাভেন’, অর্থাৎ সবুজ স্বর্গও বলে। সবুজ স্বর্গের একটা বড় অংশজুড়ে আছে পদ্মপুকুর, আর একটি হ্রদ। চুয়েট লেক নামেই শিক্ষার্থীরা চেনেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে পুব দিকে ২০ হাজার বর্গফুটজুড়ে প্রকৃতিসৃষ্ট এই হ্রদের অবস্থান। প্রতিদিনের ক্লাস-পরীক্ষার ফাঁকে একটু দম ফেলার জন্য শিক্ষার্থীরা এখানেই ছুটে আসেন। কেউ কেউ হ্রদে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ান, কারও কারও আবার গানে–আড্ডায় সোনালি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। কিন্তু এক বছর আগেও এই চিত্র ছিল ভিন্ন। হ্রদের বেশির ভাগ অংশ ছিল ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। পারতপক্ষে কেউ এর কাছে ঘেঁষতেনও না।

এই চিত্রের আমূল পরিবর্তন যাঁদের হাত ধরে হয়েছে, তাঁদের গল্পটাই বলি।

ভাবনার শুরু

গত বছরের সেপ্টেম্বরের কথা। তখন চুয়েটের চতুর্থ সমাবর্তন ও সুবর্ণজয়ন্তীর তিন মাস বাকি। এই উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যবর্ধন নিয়ে শিক্ষকদের ব্যস্ততার সীমা নেই। স্থাপত্য বিভাগের প্রধান জি এম সাদিকুল ইসলাম তখন ভাবছিলেন, চুয়েটের এই হ্রদ নিয়ে কিছু করা যায় কি না। একই বিভাগের প্রভাষক অমিত ইমতিয়াজ প্রস্তাব দিলেন, স্থাপত্য বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ডিজাইন স্টুডিওর মাধ্যমে লেকের সংস্কার করা যায়। প্রস্তাবটি খুব মনে ধরে বিভাগীয় প্রধানের। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ রফিকুল আলমের সঙ্গে কথা বলে তিনি প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে একই বিভাগের প্রভাষক মূর্ছনা মাধুরী ও অমিত ইমতিয়াজকে এ কাজের দায়িত্ব দেন।

তাঁদের তত্ত্বাবধানে নভেম্বর থেকে শিক্ষার্থীরা কাজ শুরু করেন। টানা তিন সপ্তাহ কাজ চলে। এই স্টুডিও কয়েকটি স্থায়ী স্থাপনার নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে শেষ হয়। স্থাপত্যের ভাষায় এই ধরনের প্রকল্পকে ‘ইনস্টলেশন’ বলা হয়। শিক্ষার্থীরা চুয়েট লেক আর পদ্মপুকুরের পাশে তৈরি করেন মোট ছয়টি স্থাপনা। প্রতিটি স্থাপনার নকশাই স্থান-কাল-প্রেক্ষাপটনির্ভর। রোদ কীভাবে আসছে, গাছটা কীভাবে ছায়া দিচ্ছে, পথের সঙ্গে জলাধারের দৃশ্যমান যোগাযোগ কতটুকু, মাটিটা কীভাবে নেমে গেছে, মানুষ সহজে যেতে পারছে কি না—সব মাথায় রেখে তৈরি হয় স্থাপনাগুলো।

বদলে যাওয়া পদ্মপুকুর

চুয়েটের মূল ফটক দিয়ে ঢুকেই বাঁ পাশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশের অগভীর একটি জলাশয়ে শত শত পদ্মপাতা ভেসে আছে। এই পদ্মপুকুর সব মৌসুমেই অনন্য আবেদন রাখে শিক্ষার্থীদের মনে। তাই স্থাপত্য বিভাগের পাঁচ শিক্ষার্থীর একটি দল এমনই এক স্থাপনা তৈরি করেন, যাতে বসে নির্বিঘ্নে কিছু সময় কাটানো যায়। স্থাপনাটি এমন, যেন মনে হবে পদ্মপাতাগুলোই উঠে এসেছে স্থাপনা হয়ে। কাঠামোতে আছে পাঁচটি পূর্ণ বৃত্তের প্লেট। বিভিন্ন মাপের পাঁচটি প্লেট ধাপে ধাপে নেমে গেছে পদ্মপুকুরের নিচ পর্যন্ত। এখানে বসে পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বর্ষায় পদ্ম ফুলের নাচন দেখতে কেমন লাগে, জানার অপেক্ষায় আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। 

স্থাপত্যের অনুপ্রেরণা

চুয়েট হ্রদটি সাজানোর অনুপ্রেরণা আসে উপমহাদেশের কিছু প্রাচীন স্থাপনা থেকে। মধ্যযুগে উপমহাদেশের যেসব অঞ্চলে পানি খুব দুর্লভ ছিল, সেসব জায়গায় মাটি খুঁড়ে বড় বড় কূপ খনন করা হতো। যেগুলোর উচ্চতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাটির নিচে সাততলাও ছড়িয়ে যেত। কূপগুলো ধাপে ধাপে নেমে একটি মন্দিরে গিয়ে শেষ হয়। স্থাপত্যের ভাষায় এগুলোকে স্টেপ ওয়েল বলা হয়। এই স্টেপ ওয়েলের মতো করেই স্থাপত্য বিভাগের প্রথম বর্ষের পাঁচ শিক্ষার্থী চুয়েট লেকের ধার ঘেঁষে তৈরি করেন একটি চলার পথ, যা চুয়েটের মূল সড়ক থেকে দুটি শালগাছের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে নেমে চলে গেছে একদম লেকের শেষ মাথা পর্যন্ত। এই পথের পাশেই ঘন বন। বর্ষায় গাছগুলো বড় হয়ে পুরো হ্রদটিকে ঘিরে দেয়। আবার শীতে পাতা ঝরে ডালগুলো যেন এই হ্রদকে আলোছায়ার অনন্য জ্যামিতিক নকশাই বানিয়ে ফেলে। এই প্রাকৃতিক জ্যামিতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে একই বিভাগের প্রথম বর্ষের অন্য একটি দল তৈরি করে একটি বসার জায়গা।

নতুন করে ক্যাম্পাস সাজিয়েছেন স্থাপত্যের শিক্ষার্থীরা
নতুন করে ক্যাম্পাস সাজিয়েছেন স্থাপত্যের শিক্ষার্থীরা

লেকের পাশেই একটা রাধাচূড়াগাছ বাঁকা হয়ে এসে লেকের জলে আলতো করে ছুঁয়েছে। যেন এক অর্ধবৃত্তাকার ডোম। শুধু এই প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা থেকে একই বিভাগের অন্য আরেকটি দল লেকের পাড়ে একটি অর্ধবৃত্তাকার মুক্তাঙ্গন তৈরি করে, যা ছোট একটি বৃত্তের চারপাশে তিনটি ধাপে তৈরি। ধাপগুলোর মধ্যে একটি প্রবেশপথ দিয়ে মুক্তাঙ্গনের ভেতরে যাওয়া যায়।

সুন্দর যেন থাকে

স্থাপনাগুলো যেভাবে বর্তমান শিক্ষার্থীদের মুগ্ধ করেছে, তেমনি সমাবর্তনে আসা প্রাক্তনদেরও মন ছুঁয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান যেন আফসোস করেই বলেছেন, ‘আমরা ভাবতেও পারিনি এই প্রাকৃতিক হ্রদকে এত সুন্দরভাবে দেখব। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন আড্ডার জায়গা থাকবে, এটা আমাদের সম্মিলিত দাবি ছিল। আমরা খুবই খুশি আমাদের শিক্ষক ও উত্তরসূরিদের কাছ থেকে এত সুন্দর উপহার পেয়েছি।’

বর্তমান-প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের এই উচ্ছ্বাস ছুঁয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেও। শুরু থেকেই তিনি এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন তাঁর চাওয়া, এই স্থাপনাগুলো যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়। তিনি বলেন, ‘হ্রদের পাশে এই স্থাপনাগুলো শিক্ষার্থীদের জন্যই তৈরি। আমি আশা করি, শিক্ষার্থীরা এগুলো যত্নসহকারে ব্যবহার করবে।’

তবে স্থাপত্য বিভাগের প্রধান জি এম সাদিকুল ইসলাম এখনই সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ বন্ধ করতে চান না। তিনি বলেন, ‘এখানে আমরা একটি ভাসমান রেস্তোরাঁ করতে পারি। সম্পূর্ণ রেস্তোরাঁ চলবে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে। এটি বাস্তবায়ন হলে সবার জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।’

উল্লেখ্য, গত বছরের ২৮ নভেম্বর স্থাপত্য বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের প্রথম সমাপনী জুরি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা এই স্থাপত্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন।