সোহান ও তাঁর বন্ধুরা

হল কৃষির উদ্যোক্তা মো. সোহানুর রহমান। ছবি: মোহাইমিনুল ইসলাম
হল কৃষির উদ্যোক্তা মো. সোহানুর রহমান। ছবি: মোহাইমিনুল ইসলাম

‘ধরুন খেতে বসেছেন। খাওয়ার মাঝপথে মনে হলো একটা কাঁচা মরিচ হলে জমত। বারান্দায় রাখা নিজের গাছ থেকেই একটা মরিচ ছিঁড়ে নিলেন। এই মরিচ খাওয়ার আলাদা আনন্দ আছে।’ বলার সময় মো. সোহানুর রহমানের চোখ-মুখ এমন ঝলমল করল, মনে হলো বর্ণনা দিতে গিয়েই যেন তিনি স্বাদটা অনুভব করতে পারছেন।

সোহানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) কেরামত আলী হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। প্রায় পুরো বারান্দায় ছোট ছোট গাছ দিয়ে ছেয়ে ফেলেছেন সোহান ও তাঁর বন্ধুরা। ভাঙা বোতল, পুরোনো জুতা, এমনকি ফাটা ফুটবল...বাদ যায়নি কিছুই। দেখে মনে হয় হাতের কাছে যা পেয়েছেন, তাতেই গাছ লাগিয়েছেন তাঁরা। ক্যাম্পাসে শুধু যে কেরামত আলী হলেই এমন দৃশ্য চোখে পড়বে, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলেই গাছ লাগানোর ভাবনাটা ছড়িয়ে দিয়েছেন সোহান। আর এর মধ্য দিয়েই গড়ে তুলেছেন ‘হল কৃষি’ নামের সংগঠন।

ছেলেবেলা থেকে সোহানের বাগান করার শখ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর ঠিকানা হলো হলে। জামা-কাপড়, বই-পুস্তকের সঙ্গে ‘শখ’টাও সঙ্গে নিয়ে হলে উঠলেন সোহান। বলছিলেন, ‘শুরুতে তো গণরুমে থাকতাম। হলে ওঠার পরপরই গণরুমের পাশের জানালায় বোতল কেটে গাছের চারা লাগালাম। সেই থেকে শুরু। মাথায় এল, আমার মতো সবাই যদি জানালার পাশে গাছ লাগায়, তাহলে তো সব হলই সবুজে ঢেকে যাবে! এভাবেই পথচলা শুরু।’

শখের বশে যেই পথচলা শুরু হয়েছিল, সেটা সাংগঠনিক রূপ পেতে শুরু করে ২০১৭ সালে। তারিখটা এই গাছপ্রেমী তরুণের ঠিকঠাক মনে আছে। ৩ মার্চ। সোহান বলছিলেন, ‘সেদিন আমি প্রথম রুম পেলাম। কেরামত আলী হলের ৩০৮ নম্বর ঘর, বি ব্লক। আমরা আমাদের রুমের নাম দিলাম “গ্রিন প্যালেস”।’ তত দিনে নিজেদের হল তো বটেই, সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সবুজে ছেয়ে ফেলার পরিকল্পনা করতে শুরু করেছিলেন তিনি।

পুরোনো জুতাতেও গাছ লাগিয়েছেন সোহান
পুরোনো জুতাতেও গাছ লাগিয়েছেন সোহান

এখন সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ চলছে। সোহানের সঙ্গে এখন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছেন প্রায় ২০০ ছাত্রছাত্রী। হল কৃষির ব্যানারে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন তাঁরা। শিক্ষকদের সহায়তায় গত বছর ‘গ্রিন ফেয়ার’ নামের একটা মেলা করেছেন। সোহান জানালেন, এখন পবিপ্রবি ছাড়াও বাংলাদেশের আরও পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হল কৃষির কার্যক্রম চলছে—বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কৃষি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র সোহান বলছিলেন, ‘আমরা পাত্র তৈরি করি পুরোনো প্লাস্টিক বা ফেলে দেওয়া ভাঙা জিনিস দিয়ে। তাই তেমন কোনো খরচ হয় না। আমার হল প্রভোস্ট গোপাল সাহা স্যার, আর কৃষি অনুষদের সব শিক্ষক, জার্মাপ্লাজমের পরিচালক মাহবুব রাব্বানী স্যার, সবাই শুরু থেকেই ভীষণ অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আর সার্বিক সহযোগিতা করেছে আমার ভাই রেজাউল ইসলাম, বন্ধু ইমরান, যুগল ও আল আমিন।’ কৃষি নিয়ে পড়ার সুবাদে গাছের যত্ন নেওয়াটাও সহজ হয়েছে তাঁদের জন্য। হলে সোহানের নিজের ৩৫০টি গাছ তো আছেই, ভালোবেসে দেয়াল বেয়ে বেড়ে ওঠা জংলা গাছেরও যত্ন নেন এই তরুণেরা।

‘হল কৃষি থেকে আপনি কী পেলেন?’ প্রশ্ন শুনে সোহান বোধ হয় একটু ভাবনায় পড়লেন। পাওয়া না–পাওয়ার হিসাব সম্ভবত আগে করেননি। হেসে বললেন, ‘মানসিক শান্তি, সবার ভালোবাসা আর অনেকগুলো সুন্দর, সবুজ সকাল।’