এসএসসির পর ছুটিতে

নতুন কিছু শিখে কিংবা স্রেফ মনের খোরাক জোগানোর মতো কাজ করে কাটতে পারে এসএসসির ছুটি। মডেল: সাফা, গালিব, নওরিন ও অভয়। ছবি: প্রথম আলো
নতুন কিছু শিখে কিংবা স্রেফ মনের খোরাক জোগানোর মতো কাজ করে কাটতে পারে এসএসসির ছুটি। মডেল: সাফা, গালিব, নওরিন ও অভয়। ছবি: প্রথম আলো
>এসএসসি পরীক্ষা প্রায় শেষের পথে। স্কুল পেরোনোর আগেই অনেকের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে কলেজে ভর্তির তোড়জোড়। অন্যদিকে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের লম্বা ছুটিতে সৃজনশীল কিছু শেখার বা চর্চা করার প্রস্তুতিও নিশ্চয়ই নিচ্ছে অনেকে।

এসএসসিতে অঙ্ক পরীক্ষার আগের রাতে আমার নানা মারা গেলেন। পরীক্ষা শেষে কোথাও ঘুরতে যাব, আনন্দ করব, তার জো নেই। কারণ, সবার মন খারাপ। এদিকে হাতে অফুরন্ত সময়। একগাদা বই কেনা হয়েছে। সে সময় বই কেনার জায়গা হলো ঢাকার নিউমার্কেট, নিউমার্কেটের দ্বিতীয় গেট দিয়ে ঢুকে বাঁয়ে সারি সারি বইয়ের দোকান। আমার ঘ্যানঘ্যানানির চোটে আব্বা বিরক্ত হয়ে নিউমার্কেটে নিয়ে অনেক বই কিনে দিলেন।

বন্ধুদের সঙ্গে অদল-বদল করে আরও বই এনেছি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন মোটামুটি গুলে খেয়ে শেষ করে বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা সিডনি শেলডন, আগাথা ক্রিস্টি, মিলস অ্যান্ড বুনস পর্ব চলছে, তা–ও সময় কাটে না। আমরা থাকতাম আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে। বিকেলে কোয়ার্টারের সব ছেলেমেয়ে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। সন্ধ্যায় ধূলিধূসর পায়ে বাড়ি ফিরে হাত–মুখ ধুয়েই বই নিয়ে শুয়ে পড়তাম। টেলিভিশনে ম্যাকগাইভার আর হুমায়ূন আহমেদের নাটক ছাড়া তেমন কিছু দেখার ছিল না। লেট নাইট অপেরা ডালাস বা রিটার্ন টু ইডেন আম্মা দেখতে দিতেন না। ওগুলোতে বড়দের ‘সিন’ থাকে। নিচতলার ময়না আপু ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলে ছবি আঁকা শিখতে যায়, ক্যানভাসে কাগজ চড়িয়ে ছবি আঁকে, দেখে জেদ ধরলাম আমিও শিখব। আম্মা ভর্তি করে দিলেন। সপ্তাহে দুই দিন ময়না আপুর সঙ্গে রিকশা চড়ে ছবি আঁকা শিখতে যাই। নতুন নতুন বলে প্রচণ্ড আগ্রহ। সারা দিন ছবি আঁকি। জলরঙের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে। এভাবেই এসএসসির পরের ছুটিটা দ্রুত শেষ হয়ে গেল। কোচিং? না, তখনো কলেজ ভর্তি কোচিংয়ের ব্যাপারটা চালু হয়নি। কোন কলেজে পড়ব, তা নিয়েও কারও মাথাব্যথা ছিল না।

অন্য সময়

ঠিক ৩০ বছর পরে, এ বছর আমার ছেলে যুহায়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি। ব্যবহারিক পরীক্ষা সামনে। পরীক্ষার সিট পড়েছে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে। স্কুলের সামনে অভিভাবকদের বলতে শুনি, কলেজে ভর্তির জন্য কোচিংয়ের ফরম নিয়েছেন? কোন কলেজে দেবেন? অমুক কলেজের টিচিং স্টাফ শুনেছি অত ভালো না। তমুক কলেজে সারাক্ষণ এত চাপ দিয়ে রাখে যে এইচএসসিতে স্যারের বাসায় পড়ার সময়ই মেলে না! এইচএসসিতে সময় তো খুব কম, দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। খালি নামে ভুললেই হবে না।

কদিন পরেই শেষ হবে পরীক্ষার এই দিনগুলো। গণভবন সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ছবি তুলেছেন তানভীর আহাম্মেদ
কদিন পরেই শেষ হবে পরীক্ষার এই দিনগুলো। গণভবন সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ছবি তুলেছেন তানভীর আহাম্মেদ

স্কুলের গেটের সামনে কোচিংগুলোর লিফলেট বিতরণ হচ্ছে সমানে। প্রতিদিন সেলফোনে আসছে নানা কোচিং সেন্টারের মেসেজ (কোথা থেকে নম্বর পায় কে জানে)। ইংরেজি শিক্ষার একটা কোচিং সেন্টার রীতিমতো স্টল খুলে বসেছে পরীক্ষাকেন্দ্রের সামনে। অবসর সময়ে দ্রুত অনর্গল ইংরেজি শেখার জন্য তারা এক মাসের র‌্যাপিড কোর্স চালু করেছে। শুনছি বাজারে মোটিভেশনাল (অনুপ্রেরণাদায়ী) ও জীবন গড়ার বইয়ের দারুণ চাহিদা। অভিভাবকেরা সন্তানদের এসব বই কিনে দিতে আগ্রহী। ওগুলো নাকি খুব কাজের। কার কাছে যেন শুনলাম পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই অনেকে সন্তানদের কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে ফেলেছেন। ভর্তির পড়াশোনার জন্য চাপ দিচ্ছেন।

পরীক্ষার পর ছুটিতে কী করবে ওরা? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। যুহায়েরকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘আমাকে বাসার বিভিন্ন কাজ করতে বলবে না কিন্তু। আমি কী করব বলব না!’ কী আর করবে! ওদের এখন কম্পিউটার, সেলফোন, আইপ্যাড, গুগল হোম, নেটফ্লিক্স, এক্স বক্স—কত কী আছে! সময় কাটানো কোনো ব্যাপার? একজন মা বললেন—‘উহু, আমি সাফ বলে দিয়েছি। ছুটির মধ্যে প্রোডাকটিভ কিছু করতে হবে। শুধু খেললে হবে না। ছোটখাটো কোর্সে ভর্তি করে দেব ভাবছি। আচ্ছা, ফ্রেঞ্চ ভাষা শিক্ষা কোর্সের খবর নিয়েছেন? পরে কাজে লাগতে পারে। সাঁতারের ক্লাসেও নাম দিয়ে রেখেছি।’

অনুপ্রেরণার খোঁজে

কী যে কখন কাজে লাগে, কে জানে! অকারণেই সে সময় চার বছর ছবি আঁকা শিখেছি। হয়তো কোনো কাজে আসেনি ওই ছবি আঁকার কোর্স। পরের দিকে আগ্রহও মরে গিয়েছিল। ক্যানভাস, রং আর টানত না। কিন্তু চিত্রকর্ম আর ভাস্কর্যের প্রতি অন্য রকম এক ভালোবাসা গড়ে দিয়েছিল ওই ক্লাসগুলো। এই বয়সে এসে একটা গোটা সকাল রেনে সোফিয়া মিউজিয়ামে পিকাসোর গোয়ের্নিকার সামনে স্তব্ধ বসে থাকা শিখিয়েছে ওটা, প্যারিসের মোমার্তে শিহরণ তোলা অনুভূতি জাগাতে পেরেছে। মোটিভেশন? এসএসসির পর সমরেশের গর্ভধারিণী পড়েছিলাম, জয়িতাই আমার সবচেয়ে বড় মোটিভেশন তখন। এমনকি ফেলুদা বা মাসুদ রানাকেও অনুপ্রেরণাদায়ী চরিত্র হিসেবে পেয়েছি। আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা, বকুলকথা না পড়লে কিশোরীকালে অনুপ্রেরণা পেতাম কি না, সন্দেহ। অনুপ্রেরণার জন্য আলাদা কোনো বই পড়তে হয়নি, সত্যজিৎ-সমরেশ-সুনীলরাই যথেষ্ট ছিলেন। জানি না কেন এখন মোটিভেশনের এত অভাব যে আলাদা বই পড়ে ‘মোটিভেটেড’ হতে হয়!

পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে কোচিং সেন্টারের লিফলেট বিতরণ
পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে কোচিং সেন্টারের লিফলেট বিতরণ

তার মানে এই নয় যে ছুটি মানেই খালি আনন্দ আর খেলা। এই ছুটিতে অনেক কিছুই করা যেতে পারে। গত বছর আমার এক বন্ধুর মেয়ে শ্রেয়া তার পরীক্ষার পরের ছুটিটা কাটিয়েছিল পথশিশুদের একটা স্কুলে পড়িয়ে। কী দারুণ ব্যাপার, তাই না? আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সূত্রে নানা সুন্দর কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়, বন্ধুরা মিলে করা যায় কোনো ভালো কাজ। বাড়িতে মা–বাবাকে সাহায্য করাও কিন্তু একটা ভালো কাজ। কারও যদি কিছু করতে বা শিখতে মন চায়, যেমন গিটার বা বেহালা বাজানো, কারাতে শেখা, নতুন একটা ভাষা শেখা ইত্যাদি এই সুযোগে করে নেওয়া যায়। জীবনে এগুলো কোনো কাজে আসবে কি না, তা না ভেবেই স্রেফ মনের খোরাক বা আনন্দ জোগানোর জন্য করা যায়। সবকিছু কাজে আসতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বেড়াতে যাওয়া তো যায়ই। ভ্রমণ মানুষকে উজ্জীবিত করে, অনেক চোখ খুলে দেয়। আর বই! এমন বই পড়ার অবসর খুব কমই মেলে—বিশ্বাস করো আমার কথা। এই সময়টাতে সবচেয়ে বেশি বই পড়ে শেষ করেছি আমি। জীবনটাই বদলে যাবে ভালো বইপত্র পড়লে। আর খানিকটা লেখাপড়া তো করতেই হবে, যদি এই প্রতিযোগিতার যুগে টিকে থাকতে চাও। তবে ভালো ফল বা ভালো ক্যারিয়ারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো কলেজে ভর্তি হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। একটু কম নামকরা কলেজ থেকেও ভালো ফল করা যায়। আমার এক বন্ধু এখন মেলবোর্নে বিরাট গবেষক, দুনিয়ার নামকরা সব জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র ছাপা হয়, অচিরেই বিশেষ ধরনের ইনসুলিন আবিষ্কার করতে যাচ্ছে। সে কিন্তু পাস করেছে মফস্বলের এক মাদ্রাসা থেকে। পড়াশোনা ও জানার আগ্রহটাই আসল। আর চাই অধ্যবসায়, লেগে থাকার মতো ধৈর্য। পরাজিত হয়েও উঠে দাঁড়ানোর সাহস। তোমাদের ছুটিটা সুন্দর আর অর্থবহ হোক।