রকেট সায়েন্স নয়

আয়মান সাদিক
আয়মান সাদিক

গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকটি বড় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তাদের প্রিমিয়াম সেবাগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যেমন গুগলের একটি সফটওয়্যার আছে, নাম গুগল হ্যাংআউট। এর মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্স করা যায়। করোনায় আক্রান্ত দেশগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন অনলাইনে তাঁদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে, সে জন্য গুগল হ্যাংআউট তার প্রিমিয়াম সেবাগুলো আগামী ১ জুলাই পর্যন্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছে। একই রকম উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিনির্ভর পড়ালেখার প্রতিষ্ঠান ‘ভার্সিটি টিউটরস’ (varsitytutors.com), অনলাইন শিক্ষার ওয়েবসাইট কোর্সেরা (coursera.org/coronavirus), ভারতীয় অ্যাপ বাইজুস (byjus.com), লাইভ ক্লাসের ওয়েবসাইট ভেদানতু (vedantu.com), এমন আরও বহু উদাহরণ আছে। আমাদের রবি টেন মিনিট স্কুল (10minuteschool.com) আগে থেকেই বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যায়। তবু বর্তমান পরিস্থিতিতে কীভাবে শিক্ষার্থীদের আরও বেশি সহায়তা করা যায়, তা নিয়ে আমরা ভাবছি। 

যেকোনো দুর্যোগ বা বিপর্যয়ে, বেশির ভাগ সময় আমরা সরকারের দিকে আঙুল তুলি। কিন্তু কোভিড–১৯ বা করোনাভাইরাস এমন এক দুর্যোগ, যেটা সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আসলে নিজের। সরকার ৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে, এর মানে কিন্তু ‘ছুটি’ নয়। বন্ধ রাখা হয়েছে, যেন আমরা নিজের জায়গা থেকে নিজেদের কাজটা করতে পারি। বাইরে বের না হয়ে, ঘরে বসেই অনলাইনে আমরা পড়ালেখা করতে পারি, নিজেদের আরও দক্ষ করতে পারি। সামনে আমাদের অনেক দায়িত্ব। 

ভিডিও, অডিও, পিডিএফ...
বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এরই মধ্যে অনলাইনে ক্লাস নিতে শুরু করেছেন। গুগল ক্লাসরুম, ফেসবুক লাইভ, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকছেন। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়িতে বসেই মিটিং সেরে ফেলছে অনলাইনে। এই চর্চাগুলো এখন খুব জরুরি। 

কাজটা কিন্তু একেবারেই কঠিন নয়। শিক্ষকেরা যাঁরা অনলাইনে ক্লাস নিতে চান; ভালো ক্যামেরা, বিশাল স্টুডিও, কারিগরি সুবিধা—এসব কিছুই আপনার প্রয়োজন নেই। স্রেফ একটা স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই হলো। শিক্ষার্থীদের সুবিধা আর আপনার পড়ানোর বিষয় অনুযায়ী আপনি নিজের মতো করে একটা পথ তৈরি করে নিতে পারেন। সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ফেসবুকে একটা গ্রুপ খুলে ফেলা (অনেক ক্লাসের নিশ্চয় আগে থেকেই গ্রুপ আছে)। সেখানে লাইভ ভিডিওতে আপনি ক্লাস নিতে পারবেন, শিক্ষার্থীদের সরাসরি প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারবেন। টেন মিনিট স্কুল লাইভ (fb.com/groups/10 MinuteSchoolLIVE) নামে আমাদের একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে, যেখানে আমরা লাইভ ক্লাস নিই। এই গ্রুপের সদস্যসংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। তার মানে একটা বড়সংখ্যক ছেলেমেয়েই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত। 

রবি টেন মিনিট স্কুলের পক্ষ থেকে আমরা একটা কাজ করেছি। আমাদের যত শিক্ষক আছেন, সবার কাছে গত বুধবার রাতেই একটা করে ছোট হোয়াইট বোর্ড, একটা মোবাইল স্ট্যান্ড, মার্কার আর ডাস্টার পাঠিয়ে দিয়েছি। সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে এক হাজার টাকারও কম। এখন তাঁরা সবাই বাসায় বসেই ক্লাস নিতে পারছেন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও চাইলে এই উদ্যোগ নিতে পারে। 

যাঁরা লাইভ ক্লাস নিতে পারছেন না, চাইলে ভিডিও আপলোড করে দিতে পারেন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের সময় অনুযায়ী ভিডিও দেখে নেবেন। ভিডিও পাঠানো যদি সম্ভব না হয়, তাহলে পাওয়ার পয়েন্ট/পিডিএফে তৈরি স্লাইড পাঠিয়ে দিন, সঙ্গে নাহয় স্লাইডের বর্ণনা দিয়ে একটা অডিও-ও থাকল। দুটো মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়ে নেবেন। অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষক আছেন, যাঁরা ক্লাসে চমৎকার পড়ান, কিন্তু অনলাইনের সঙ্গে ততটা অভ্যস্ত নন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ একজন দায়িত্ব নিয়ে সেই শিক্ষকের অডিও/ভিডিও/স্লাইড সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। 

আরেকটা বড় সুবিধার কথা শুরুতেই বলেছি। বড় প্ল্যাটফর্মগুলো যেহেতু তাদের প্রিমিয়াম ক্লাসগুলো ফ্রি করে দিয়েছে, চাইলে ঘরে বসেই কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা হার্ভার্ড, অক্সফোর্ডের শিক্ষকদের ক্লাস করতে পারেন। অনেক রকম কর্মশালা বা দক্ষতাভিত্তিক কোর্সেও অংশ নেওয়ার সুযোগ আছে। 

আবার এটাও সত্যি, অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই হয়তো ইন্টারনেট ততটা সহজলভ্য নয়। সে ক্ষেত্রে তাঁরা সপ্তাহে একদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। মোবাইল অপারেটরগুলোর বেশ কিছু এক দিনের প্যাকেজ আছে। ২০-৩০ টাকায় একদিনের জন্য ১ জিবি (গিগাবাইট) প্যাকেজ কিনে নেওয়া যায়। চাইলে একদিনে সবগুলো ভিডিও/স্লাইড/পিডিএফ ডাউনলোড করে পুরো সপ্তাহ ধরে সেগুলোর ওপর প্রস্তুতি নেওয়া যায়। মোটকথা, নিজের সুবিধামতো একটা পদ্ধতি বের করে নিতে হবে। 

অনলাইনে কেন পড়ব

চীন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও ওরা পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। ওদের জন্য কাজটা সহজ। কারণ অনেক আগে থেকেই বাইরের দেশগুলোতে পড়ালেখার ক্ষেত্রে অনলাইন ও অফলাইন, দুটো মাধ্যমই সমানভাবে ব্যবহার করে। আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হয়তো অনলাইনে পড়ালেখা করানোর ব্যবস্থা আগে সেভাবে ছিল না। কিন্তু এই দুর্যোগের সময় আমরা সেটা শুরু করে দিতে পারি। 

অনেকে বলতে পারেন, কটা দিন পড়ালেখা বন্ধ রাখলে কী হয়? কেন আমাকে অনলাইনের সাহায্য নিয়ে হলেও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে? সে ক্ষেত্রে আমার পাল্টা প্রশ্ন হলো, কত দিন বন্ধ থাকবে, সেটা কি আমরা জানি? আমরা কেন, কেউই জানে না। চীনে সবকিছু বন্ধ আছে প্রায় দুই মাস হয়ে গেল, তারা এখনো সামলে উঠতে পারেনি। অতএব অনিশ্চয়তায় না থেকে দ্রুতই একটা পদ্ধতি দাঁড় করিয়ে ফেলা উচিত। 

ভয়ের কথা হলো, অন্যান্য দেশের পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের পরিস্থিতি মেলালে চলবে না। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশে আমরা থাকি। এখানে ভাইরাস কতটা ছড়াবে, সেটা হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। আবার অন্যদিকে আশার কথা হলো, ভাইরাসের ধরন, এটা কীভাবে ছড়ায়, কীভাবে কোভিড–১৯ থেকে সতর্ক থাকা যায়—এসব আমাদের জানা। চীন, ইতালি তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভাইরাস অনেক দূর ছড়িয়ে পড়েছে। ওদের দেখে আমরা সতর্ক হতে পারি। 

বড় একটা অর্থনৈতিক ধাক্কা অপেক্ষা করছে সারা বিশ্বের জন্য। আমাদের ছোট্ট দেশটা এই ধাক্কা কীভাবে সামলাবে জানি না। কিন্তু আমরা নিশ্চয়ই ঘরে বসে ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারি। আগেই বলেছি, সামনে আমাদের অনেক দায়িত্ব।

 লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, রবি টেন মিনিট স্কুল