ক্লাসরুম হাজির অনলাইনে

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
>করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ আছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বের অনেক দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমরাও কী এই ধারায় যুক্ত হতে পারি? কীভাবে? লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এহসান হক

আদিম যুগে মানুষ কাঁচা মাংস খেত। হঠাৎ একদিন মাংসের একটা টুকরা ভুলবশত আগুনে পড়ে গেল। ঝলসানো ওই মাংস পেটে ঢোকার পর মানুষ আর কাঁচা মাংসের দিকে হাত বাড়ায়নি। অনলাইন লার্নিং বা অনলাইনে পড়ালেখাও কি আমাদের জীবনে এ রকম একটি পরিবর্তন আনবে? 

অনলাইন লার্নিং নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে ১০ বছরের কাছাকাছি সময় ধরে। তারপরও অনলাইন লার্নিং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। কারণ অনেকেই মনে করেন, ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে খচখচ শব্দে সমীকরণ লিখে তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করে নেওয়া—‘সবাই বুঝল তো?’ ব্যাপারগুলো অনলাইনে কখনোই পাওয়া যাবে না।

ভালো শিক্ষকেরা জানেন যে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের দেওয়ার মতো আমাদের কিছুই নেই। কারণ তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে শিক্ষার যাবতীয় পাঠ্যক্রম অনলাইনে বিনা মূল্যে পাওয়া যায়। তাহলে শিক্ষার্থীরা কাঠখড় পুড়িয়ে এবং (বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে) বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে ক্লাসে কেন আসেন? উত্তর একটাই—শিক্ষক ক্লাসরুমে এমন এক পরিবেশ তৈরি করেন, যেন শিক্ষার্থীরা একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারেন। অনেকেরই ধারণা যে একে অপরের কাছ থেকে শেখার প্রবণতাটি অনলাইনে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। ব্যাপারগুলো কি ভুল? উত্তর কারও জানা নেই। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে ক্লাসরুমগুলো বন্ধ। অনলাইন ছাড়া এখন উপায় নেই। তাই প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করার দায়িত্বও এখন আপনার। 

কিছু ‘প্রায়ই জিজ্ঞাসিত’ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাক। 

জুম নামের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনলাইনে এক হতে পারেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
জুম নামের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনলাইনে এক হতে পারেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

শিক্ষার্থীরা কি অনলাইনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে? 

প্রশ্নটা আমারও ছিল। তাই প্রথমেই আমি আমার শিক্ষার্থীদের এক অনলাইন প্রশ্নাবলি দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি। সবাই দেখি অনলাইন প্রযুক্তি নিয়ে বেশ স্বচ্ছন্দ। মনে রাখতে হবে, আমাদের এখনকার শিক্ষার্থীরা বড় হয়েছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্নাপচ্যাটের যুগে। তাদের জন্য এই প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত হওয়া খুব সহজ। 

 শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ‘টিমওয়ার্ক’ কী করে করবে? 

অনেকেই ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন দিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য ২-৩ জনের সঙ্গে আলোচনা করতে বলেন। আলোচনা শেষে সবাই তাদের আলোচনার সারাংশ সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন। এ ব্যাপারটা অনলাইনে কী করে সম্ভব? জুম বলে একটা সফটওয়্যার আছে (বিনা মূল্যে নামিয়ে নেওয়া যাবে এই ওয়েবসাইট থেকে: zoom.com), এখানে বিনা মূল্যে ১০০ জন শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনলাইনে ক্লাস করা সম্ভব। সফটওয়্যারের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘ব্রেকআউট রুম’। ব্রেকআউট রুম ব্যবহার করে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট রুমে ভাগ করে দিতে পারবেন। তারপর নিজে এক রুম থেকে আরেক রুমে ঢুকে দেখতে পারবেন, কী হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের পর সবাইকে আবার ভার্চ্যুয়াল ক্লাসরুমে ফেরত নিয়ে আসতে পারবেন। জুমে আরও আছে ‘লাইভ পোলিং’–এর ব্যবস্থা। ধরুন, একটি বিষয় পড়ানোর পরে আপনি প্রশ্ন করে ঝালাই করে দেখতে চান অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা বুঝল কি না। এ কাজটি করতে পারবেন মাত্র কয়েকটা মাউস ক্লিকে। চিন্তায় আছেন, শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার অন করে ক্লাসের বাইরে অন্য কিছুতে মনোযোগ দেবে কি না? জুমের আরেকটা ফিচার হলো, ভার্চ্যুয়াল ক্লাসরুমে কেউ যদি মনিটরের দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে, তাহলে শিক্ষক সঙ্গে সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীদের নাম পেতে পারেন।

 পরীক্ষা কীভাবে নেব? 

এখানে দরকার একটি অভিনব ভাবনার। পরীক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা মৌলিক ব্যাপারটা বুঝল কি না, সেটা যাচাই করা। অনেকেই মনে করেন, যেসব প্রশ্নের উত্তর বই ঘেঁটে খুব সহজেই বের করা সম্ভব, সে প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞান যাচাই করতে সক্ষম নয়। শিক্ষক হিসেবে এখন সময় এসেছে চিন্তা করার—পরীক্ষায় কী প্রশ্ন করা যায়, যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বই ঘেঁটেও বের করা সম্ভব নয়। প্রশ্নের পাতাগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাবেন কী করে? অনেক প্রশ্ন এখন গুগল ফরমের মাধ্যমেই করা সম্ভব। তাতে প্রশ্ন প্রিন্ট করার ঝামেলা আর থাকে না। 

 লোডশেডিং হলে কী হবে? 

জুমে ক্লাস নিতে নিতে যদি লোডশেডিং হয়? চিন্তা নেই। শিক্ষার্থীরা তখন একটি নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করে পুনরায় ক্লাসে ফেরত আসতে পারবেন, ফোনে লেকচার শুনতে পারবেন। শিক্ষকও তার পুরো ভিডিওটি সরাসরি ধারণ করে পরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবেন।

 জুমের ‘ফ্রি ভার্সন’–এ মাত্র ৪০ মিনিট লেকচার দেওয়া যায়, তারপরে কী হবে?

করোনাভাইরাসের জন্য এই সময়সীমা এখন তুলে নেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাইলে প্রতিষ্ঠানের সবার জন্য লাইসেন্স কিনতে পারেন। উত্তর আমেরিকার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনলাইন লার্নিং এখন জুমের মাধ্যমে চলছে। 

 আমি ক্লাসরুমে বোর্ড ব্যবহার করি, অনলাইনে কী করব? 

জুম সফটওয়্যার ব্যবহার করে আপনি আপনার কম্পিউটার স্ক্রিন শেয়ার করতে পারবেন। জুমে ‘হোয়াইটবোর্ড’–এর ব্যবস্থা আছে। ভার্চ্যুয়াল ‘হোয়াইটবোর্ড’ ব্যবহার করে আপনি মাউস এবং কি-বোর্ড দিয়ে সমীকরণ লেখা থেকে শুরু করে যা ইচ্ছে লিখতে পারবেন।

 এখন গবেষণা চলছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে অনলাইন লার্নিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আবেগ বোঝা সম্ভব কি না। তাতে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের মতামত বা ফিডব্যাক পেতে পারেন—কোন বিষয়টা পড়ানোর সময়ে শিক্ষার্থীরা মজা পেয়েছিল, বা কোনটা পড়ানোর সময়ে শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্তিতে পড়েছিল। এ ধরনের তথ্য অবশ্যই একজন শিক্ষককে সচেতন করে তুলবে। বাংলাদেশে যেহেতু এখন কম্পিউটার সাক্ষরতা এবং ব্রডব্যান্ডের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম, অনলাইন লার্নিং ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করার আগে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক দিকগুলোর সঠিক পর্যালোচনা প্রয়োজন। 

 লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কম্পিউটারবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার, নিউইয়র্ক 

 আরও বিস্তারিত জানতে ভিডিও দেখুন অনলাইনে