অণুজীববিজ্ঞান পড়ার সময় এখন

>করোনাভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী জীবাণু শনাক্ত করতে এবং এর প্রতিষেধক তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন অণুজীববিজ্ঞানীরা। ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকতে হলে তাই আমাদের এমন অনেক লোকবল দরকার, যাঁরা অণুজীব নিয়ে গবেষণা করবেন। অণুজীববিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখার নানা দিক নিয়ে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম

১৯৭৬ সালে ডাচ বিজ্ঞানী অ্যানটনি ভ্যান লিউভেনহুক ‘অ্যানিমেলকিউলস’ (animalcules) নামে যে জীবটি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে দেখেছিলেন, তা ছিল একটি অণুজীব। অণুজীব হলো ক্ষুদ্র জীব, যা খালি চোখে দেখা যায় না। বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, নীলাভ সবুজ শৈবাল, প্রোটোজোয়া ইত্যাদি অণুজীবের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের পৃথিবীতে যত অণুজীব আছে, তার ৯৫ শতাংশই মানুষের জন্য কল্যাণকর। শুধু ৫ শতাংশ অণুজীব ক্ষতিকর; যা মানুষ, পশু-পাখি, গাছপালায় রোগ–ব্যাধি সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন—ওষুধ, কৃষি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, খাদ্য ইত্যাদিতে অণুজীববিজ্ঞানের (মাইক্রোবায়োলজি) ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। অণুজীব ব্যবহার করে আমরা পরিবেশ দূষণ দূর করতে পারি, যা পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী। এ ছাড়া খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো, বিভিন্ন রোগ শনাক্তকরণ, রোগের প্রতিষেধক তৈরি, বিরূপ আবহাওয়ায় বীজ ও গাছ উৎপাদন (লবণ প্রতিরোধী গাছ) করাসহ বিজ্ঞানের প্রায় সব ক্ষেত্রে অণুজীববিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অণুজীববিজ্ঞান একটি গবেষণাধর্মী বিষয় হওয়ায় এর নতুন নতুন আবিষ্কার এবং মানব কল্যাণে এর প্রয়োগ অত্যন্ত আনন্দের, যা নতুন প্রজন্মকে এ বিষয়ে পড়তে আগ্রহী করতে পারে।

অণুজীববিজ্ঞানীদের কাজের সুযোগ

শুধু আনন্দের জন্য নয়, পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্যও অণুজীববিজ্ঞানে পড়া যেতে পারে। দেশে যেমন বাংলাদেশ শিল্প ও গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (এনআইবি), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর, বি), জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর (আইপিএইচ), নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বিমান, বিএসটিআই ইত্যাদি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও গবেষণার সুযোগ আছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণাও করা যায়।

এ ছাড়া বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওষুধ কোম্পানি, বায়োটেক কোম্পানি, বিভিন্ন খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ নানা ক্ষেত্রে অণুজীববিজ্ঞানীদের চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা সহজেই উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারেন।

অণুজীব ও অণুজীববিজ্ঞানীদের ভূমিকা

এই মুহূর্তে সারা বিশ্ব যে অণুজীবের কারণে থমকে আছে, তা হলো করোনা নামক একটি ভাইরাস। পুরো মানবজাতির জীবন এই ভাইরাস বিপন্ন করে তুলেছে। তাই শুরুতে স্বাস্থ্য খাতে অণুজীব ও অণুজীববিজ্ঞানীদের গুরুত্বের কথা খানিকটা বলে নিলাম। বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের জীবাণু শনাক্তকরণ, রোগের প্রতিষেধক তৈরি, অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি, ওষুধের মাইক্রোবায়োলজিক্যাল গুণগত মান নির্ণয়, ইত্যাদিতে অণুজীবদের গুরুত্ব অনেক। এ ছাড়া বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে বিভিন্ন অণুজীব থেকে জীবন রক্ষাকারী ইনসুলিন, হরমোন, এনজাইম, রিকমবিন্যান্ট ড্রাগও তৈরি করা যায়।

কৃষি ক্ষেত্রে অণুজীববিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অণুজীব ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব সার ও কীটনাশক তৈরি করছেন, যা বিভিন্ন দেশে রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে। এ ছাড়া জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে, যা পৃথিবীতে খাদ্যচাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রোগপ্রতিরোধী বীজ ও গাছ উৎপাদনে অণুজীববিজ্ঞানীদের ভূমিকাও অপরিসীম।

এবার আসি স্বাস্থ্য খাতে। বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, যারা বায়োটেকের মাধ্যমে ইনসুলিন, হরমোন, ক্যানসার প্রতিরোধক ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, রোগপ্রতিষেধক টিকা ইত্যাদি জীবনদানকারী উপাদান উৎপাদন করছে, যেখানে অণুজীববিজ্ঞানীরা তাঁদের অবদান রাখছেন। অণুজীববিজ্ঞানীরা বিভিন্ন খাদ্য, ওষুধ, পানি ইত্যাদির মান নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। বাংলাদেশ একটি নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ। এ দেশের জনগণ নিজেদের স্বাস্থ্য ও পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা নিয়ে এখনো সচেতন নয়। এ বিষয়ে অণুজীববিজ্ঞানীরা সচেতনতা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন।

কৃষি ও খাদ্য গবেষণার ক্ষেত্রে অণুজীববিজ্ঞানীদের ভূমিকাও আলাদা করে বলা প্রয়োজন। অণুজীববিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অণুজীব ব্যবহার করে পোকামাকড় ও বিভিন্ন রোগপ্রতিরোধী গাছ (যা ট্রান্সজেনেটিক প্লান্ট নামে পরিচিত। যেমন: বিটি কটন, বিটি কর্ন) উৎপাদন করে থাকেন। যার ফলে মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। অনেক অণুজীব আছে, যেগুলোকে জৈব সার ও কীটনাশক হিসেবে বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হয়। এটি পরিবেশবান্ধব। কারণ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ক্যানসারসহ অনেক রোগ সৃষ্টি এবং পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। অণুজীববিজ্ঞানীরা খাদ্য ও পানির মাইক্রোবায়োলজিক্যাল গুণগতমানও নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য যেমন রুটি, দই ইত্যাদি তৈরিতে অণুজীব ব্যবহার করা হয়।

অনেক অণুজীব ব্যবহার করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত করা যায়। একে বলা হয় বায়োরেমিডিয়েশন। যেমন এই পদ্ধতির মাধ্যমে সমুদ্রের তেল, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ দূর করা সম্ভব। বিভিন্ন শিল্প যেমন চামড়া ও ডিটারজেন্ট তৈরিতে অণুজীব থেকে তৈরি বিভিন্ন এনজাইম ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন শিল্প–কারখানার বর্জ্য পরিশোধনেও অণুজীব ব্যবহার করা হয়। মানবকল্যাণে অণুজীববিজ্ঞানের বহুমাত্রিক ব্যবহার একটি পরিবেশবান্ধব ও সুন্দর পৃথিবী গড়তে সাহায্য করে।

বাংলাদেশে অণুজীববিজ্ঞানীদের প্রয়োজনীয়তা

আমাদের দেশে প্রায় ১০-১২টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ আছে। তবে আমরা এখনো অণুজীববিজ্ঞান গবেষণায় উন্নত দেশের তুলনায় অনেকখানি পিছিয়ে আছে। গবেষণার তহবিলের অপ্রতুলতা, গবেষণার সুবিধার অভাব, এখনো অনেক বায়োটেক প্রোডাক্ট, কেমিক্যাল রিজেন্ট ইত্যাদির জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হয়। আমরা এখনো সংক্রামক ব্যাধি, যেমন—শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের জন্য দায়ী ভাইরাসের জন্য কোনো আলাদা গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারিনি। এ কথা বলার অর্থ হলো, এখন যেমন সারা বিশ্ব করোনাভাইরাসের কারণে ভুগছে; এই সংক্রমণের ফলে আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণ, প্রতিষেধক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সঙ্গে অণুজীববিজ্ঞানীরাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

আরও একটি উদাহরণ হলো কৃষি ক্ষেত্র। পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের নিজস্ব জৈব কীটনাশক তৈরি করছে এবং তা রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে। কারণ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ক্যানসারসহ অনেক রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী এবং পরিবেশ দূষণের অন্যতম একটি কারণ। আমার জানা মতে, বাংলাদেশে ল্যাবরেটরি পর্যায়ে কিছু গবেষণা হলেও মাঠপর্যায়ে ব্যবহারের জন্য ব্যাপকভাবে উৎপাদন শুরু করতে আমাদের এখনো অনেক দূর যেতে হবে।