শিক্ষাপঞ্জি এলোমেলো

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু ও শেষ হয় শিক্ষাপঞ্জি (একাডেমিক ক্যালেন্ডার) অনুযায়ী। কিন্তু বিএনপিসহ ২০-দলীয় জোটের টানা হরতাল-অবরোধে শিক্ষাপঞ্জি এলোমেলো হয়ে গেছে। ক্লাস না হওয়ায় সিলেবাস শেষ হচ্ছে না। পরীক্ষার সময়সূচিও এখন ওলট-পালট।
চলতি এসএসসির প্রায় ১৫ লাখ পরীক্ষার্থী জানে না, তাদের পরীক্ষা কবে শেষ হবে। একই কারণে ১ এপ্রিল শুরু হওয়া এইচএসসি পরীক্ষাও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। আবার ক্লাস না হলেও স্কুলগুলোতে নিয়মিত পরীক্ষা ঠিকই নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা শিখল কি শিখল না, সেটা দেখার সুযোগ থাকছে না। এভাবে পরীক্ষা নেওয়ায় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপও পড়ছে।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। গত রবি ও সোমবার রাজধানীর ছয়টি স্কুল ও কলেজে গিয়ে হতাশার চিত্র পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) হরতাল-অবরোধে ক্লাস-পরীক্ষা নিতে বললেও বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরোদমে ক্লাস-পরীক্ষা হচ্ছে না। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে সেশনজট সৃষ্টি হবে।
তবে গতকাল হরতাল শিথিল করায় এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল, ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট যোসেফ স্কুলসহ অনেক স্কুল-কলেজ ক্লাস নিয়েছে। কিন্তু রাতে খুদে বার্তা পাঠিয়ে সকালেই ক্লাস হওয়ায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল কম।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, কৌশল করে শুক্র ও শনিবার এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া হলেও সার্বিকভাবে শিক্ষায় বড় ধরনের আঘাত লেগেছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের ‘সর্বনাশা’ কার্যক্রমের জন্য শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। এর মাশুল গুনতে হবে ৪০ বছর ধরে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন ক্লাস হলেও ঘাটতি থাকবেই। সেই ঘাটতি কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া যায়, তার চেষ্টা চলছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ক্ষতি পোষাতে এবার গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাদ দেওয়া এবং জুনে রোজার ছুটিও কমিয়ে আনার চিন্তাভাবনা চলছে।
জানতে চাইলে উদ্বেগ প্রকাশ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা হোঁচট খেয়ে উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতি কবে, কীভাবে স্বাভাবিক হবে, তা-ও কেউ জানে না।’
এবার শিক্ষাবর্ষের শুরুটাই হয়েছে হরতাল দিয়ে। বছরের প্রথম দিনে হরতালের মধ্যেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হয়। সেদিন হরতাল ডেকেছিল ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী। এরপর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ২০ দলের কর্মসূচি ঘিরে শুরু হয় উত্তেজনা। ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় টানা অবরোধ। ফেব্রুয়ারি থেকে অবরোধের সঙ্গে হরতালও দেওয়া হচ্ছে। চলছে সহিংসতা, পেট্রলবোমা হামলা, নাশকতা। এতে আতঙ্কিত অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠাতে চাইছেন না। এ কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় স্থবিরতা নেমে এসেছে।
বর্তমানে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থী আছে ৪ কোটি ৪৪ লাখ। এ ছাড়া কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে আরও ৩০ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে চলমান মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের প্রায় ১৫ লাখ পরীক্ষার্থী। পূর্বঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী ২ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল ১০ মার্চ। কিন্তু হরতালের কারণে সব পরীক্ষাই পেছাতে হয়েছে। ব্যবহারিক ছাড়াই এখনো ছয় দিনের পরীক্ষা বাকি। ১২ ফেব্রুয়ারির স্থগিত পরীক্ষা ১৩ মার্চ এবং ১ মার্চের স্থগিত পরীক্ষা ১৪ মার্চ পুনরায় নির্ধারণ করা আছে। ৩, ৪, ৮ ও ১০ মার্চের পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়েছে। গতকাল ৩ ও ৪ তারিখের পরীক্ষা যথাক্রমে ২০ ও ২১ মার্চ পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আজ বুধবারের দাখিল পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নতুন তারিখ ঠিক করতে গিয়ে তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন। বারবার পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় পরীক্ষার্থীরাও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে, অনেকের পরীক্ষা খারাপ হচ্ছে।
ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, শুক্র ও শনিবার পরীক্ষা নেওয়া গেলে ২৮ মার্চ লিখিত পরীক্ষা শেষ করা যাবে। ব্যবহারিক পরীক্ষা ১২ মার্চ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত নেওয়ার কথা। এর আগে আজ ১১ মার্চ সংগীত বিষয়ের পরীক্ষা আছে। কিন্তু এগুলো নিয়ে তাঁরা খুব অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। তবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শ্রীকান্ত কুমার চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, যদি ২৮ মার্চের মধ্যেও এসএসসি পরীক্ষা শেষ করা যায়, তাহলে পরের পাঁচ দিনের মধ্যে ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ করা হবে। তাই ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরু করতে কোনো অসুবিধা হবে না।
স্কুল-কলেজে সমস্যা বেশি: গত রোববার সকালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে গিয়ে অভিভাবকদের ভিড় দেখা যায়নি। ভেতরেও ছাত্রছাত্রী ছিল না। তবে অফিস খোলা। অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, গত জানুয়ারি থেকে নতুন ভর্তি হওয়া প্রথম শ্রেণিসহ কয়েকটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একটি ক্লাসও নেওয়া সম্ভব হয়নি। শুধু বোর্ডের পরীক্ষা থাকায় সমস্যার মধ্যেও পঞ্চম, অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শুক্র ও শনিবার বিকেলে কিছু ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র থাকায় অন্যান্য শ্রেণির ক্লাসও নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
অধ্যক্ষ জানান, শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী ১১ থেকে ১৯ এপ্রিল টিউটোরিয়াল পরীক্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু ক্লাস না হওয়ায় সিলেবাস শেষ করা যাচ্ছে না। তাই টিউটোরিয়াল পরীক্ষা নেওয়া যাবে কি না, তা অনিশ্চিত। এরপর ১ জুন থেকে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা আছে। তিনি বলেন, লেখাপড়া শেষ না করে শুধু পরীক্ষা নিয়ে কী হবে!
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি শাখার প্রধান বলেন, তাঁরা শুক্র ও শনিবার ক্লাস নিচ্ছেন। কিন্তু এভাবে কি ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব?
গত রোববার মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে শুধু শিক্ষকদের পাওয়া যায়, শিক্ষার্থী ছিল না। দুই স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা জানালেন, এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র থাকায় ক্লাস বন্ধ। কিন্তু কবে পরীক্ষা শেষ হবে, তা নিয়ে তাঁরা উদ্বেগের মধ্যে আছেন।
মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক ছাত্রীর মা রামপুরার বাসিন্দা শাহনাজ বেগম বলেন, স্কুলে ক্লাস না হওয়ায় এখন কোচিংই ভরসা। তিনি এসেছিলেন মেয়ের বেতন দিতে। পাশের একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, একটি কক্ষে একজন শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন। একজন শিক্ষক বলেন, অবরোধ-হরতালের শুরুর দিকে শিক্ষার্থীরা আসত না। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ক্লাস হচ্ছে।
গত সোমবার রাজধানীর আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েও কোনো শিক্ষার্থীর দেখা মেলেনি। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে শুক্র ও শনিবার ক্লাস হয় বলে জানা গেছে। এ রকম পরিস্থিতিতেই বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে ক্লাস না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা ভালোভাবে দিতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়েও হরতালের আঘাত: ১ মার্চ ইউজিসি উপাচার্যদের ডেকে সভা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেন। কিন্তু গত সোমবার অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে না। প্রথম আলোর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি জানান, সব বিভাগে ক্লাস হচ্ছে না, কিছু বিভাগে হচ্ছে। এ কারণে আগে থেকেই সৃষ্টি হওয়া ছয়-সাত মাসের সেশনজটের সঙ্গে আরও দুই-তিন মাসের সেশনজট যুক্ত হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, সেখানেও কিছু কিছু বিভাগে ক্লাস হচ্ছে। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি জানান, সেখানে গত ৯ জানুয়ারি থেকে কোনো ক্লাস হচ্ছে না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা হচ্ছে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সমস্যায় পড়েছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, ইউজিসির সিদ্ধান্তের পর তাঁরা ক্লাস-পরীক্ষা নিলেও এর আগে ক্লাস-পরীক্ষা না হওয়ায় সেমিস্টার এক থেকে দেড় মাস পিছিয়ে যাবে।
ইংরেজি মাধ্যম স্কুল: ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে ক্লাস না হলেও সম্প্রতি শুক্র ও শনিবার ক্লাস নেওয়া শুরু হয়। এর আগেই গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের দুই দিনের পরীক্ষা দিতে পারেনি এ দেশের পরীক্ষার্থীরা। ফলে তারা পিছিয়ে গেছে।

হরতালের কারণে এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে নেওয়া হচ্ছে শুক্র ও শনিবার। লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল ১০ মার্চ।
বর্তমানে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায়
৪ কোটি ৭৪ লাখ
শিক্ষার্থীও হরতাল অবরোধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে