সফলতা মাপার সূচক

পিএইচডি শেষ করে তখন অধ্যাপনায় যুক্ত হয়েছি। হঠাৎ দেখি আমার পিএইচডির উপদেষ্টা ডাকযোগে একটি বই পাঠিয়েছেন। বইয়ের নাম হাউ উইল ইউ মেজার ইয়োর লাইফ? (তুমি তোমার জীবনকে কীভাবে পরিমাপ করবে?) লিখেছেন হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের প্রয়াত অধ্যাপক ক্লেয়টন ক্রিসটেনসন।

লেখক তাঁর এমবিএ করেছেন প্রখ্যাত হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে। যেখানে ভর্তি হতে হলে খুব মেধাবী হতে হয়। এমবিএর পর ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রতি পাঁচ বছর পরপর পুনর্মিলনীর আয়োজন করা হয়। পাঁচ বছর পরে যখন সবাই ফেরত এলেন, সবার মধ্যে কী আনন্দ! সবাই বড় প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদবিতে নিয়োগ পেয়েছেন। অঢেল উপার্জন, দামি গাড়ি, বাড়ি আর সঙ্গে সিনেমার নায়ক বা নায়িকাদের মতো দেখতে সুদর্শন বা সুদর্শনা জীবনসঙ্গী। সবার সুখময় জীবন—যেমনটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তী ১০, ১৫, ২০, ২৫তম পুনর্মিলনীতে ব্যাপারটা অন্য রকম হয়ে গেল। লেখকের অনেক বন্ধুই ভীষণভাবে অসুখী। অনেকেরই বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। কেউ কেউ আবার বিয়ে করেছেন। শারীরিক দূরত্বের কারণে সন্তানদের সঙ্গে বছরে একবারের বেশি দেখা হয় না। কোনো কোনো বন্ধু আবার দুর্নীতির মামলায় জেল খাটছেন। কিন্তু হার্ভার্ডে থাকাকালীন তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন অসম্ভব মেধাবী, নৈতিক ও সুহৃদ। তাঁদের কেউই জীবনে অসুখী হওয়ার পণ করে চাকরি ও পারিবারিক জীবন শুরু করেননি। তাহলে গোলমালটা ঘটল কোথায়?

জীবনে কৃতিত্ব অর্জনের দুটি ক্ষেত্র আছে—পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্র। দুইটার ধরনও বেশ ভিন্ন। কর্মক্ষেত্রে দৈনিক ৮ ঘণ্টার জায়গায় ১০ ঘণ্টা কাজ, কিংবা রাত জেগে একটু বেশি পরিশ্রম, যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করে জ্ঞানগর্ভ আলাপচারিতার ফল খুব দ্রুত পাওয়া যায়।

অন্যদিকে পরিবারের পেছনে একটু বেশি সময় ব্যয় করা, সন্তানদের সঙ্গে একটু বেশি সময় কাটানোর ফলাফল দ্রুত মেলে না। তাই অনেকেই ভাবেন—এখন একটু বেশি কাজ করি। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর উপলক্ষ তো পাওয়াই যাবে। লেখকের মতে, ভুলের উৎপত্তি এখানেই। একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন তিনি।

‘ডেল’ কোম্পানি কোনো একসময়ে একচেটিয়া কম্পিউটারের ব্যবসা করত। তাদের কোনো প্রতিযোগী ছিল না। ডেলের কর্মকর্তারা ভাবলেন, কম্পিউটারের মাদারবোর্ড নিজেদের কোম্পানিতে প্রস্তুত না করে যদি আসুস কোম্পানি থেকে আমদানি করেন, তাহলে লাভ অনেকাংশে বেড়ে যায়। যে–ই ভাবা, সে–ই কাজ। কর্মকর্তা আরও খেয়াল করলেন যে কম্পিউটারের র‌্যাম নিজেরা প্রস্তুত না করে যদি আসুস থেকে কেনা যায়, লাভ তখন দ্বিগুণে গিয়ে ঠেকে। এমনি করতে করতে দেখা গেল, ডেলের যাবতীয় সরঞ্জামই আসছে আসুস থেকে। এই ফাঁকে আসুস ভাবল, খামোখা ডেলকে সরঞ্জাম সরবরাহ করার চেয়ে আমি নিজেই তো কম্পিউটার তৈরি করে বাজারজাত করতে পারি। এভাবেই ডেল খাল কেটে কুমির এনে তার বাজারের এক বিশাল শেয়ার হারিয়েছিল আসুসের কাছে।

অনেক অভিভাবক মনে করেন, তাঁদের সন্তানদের অনেক ধরনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। সেই জন্য সন্তানদের ভর্তি করে দেন হরেক রকম ক্লাসে—সাধারণ বিজ্ঞান থেকে শুরু করে গান, নাচ, চিত্রাঙ্কন, কারাতে, অভিনয়, খেলাধুলা আরও কত কী। এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে নিয়ে যাওয়া নিয়েই কাটিয়ে দেন পুরো সময়। আর ভাবেন, আমি তো আমার সামর্থ্যমতো করছিই। লেখকের মতে, সন্তানদের সঙ্গে নতুন কিছু শেখার এই অভিজ্ঞতাগুলোকে কখনো আউটসোর্স করতে নেই। যে ভুলটা ডেল করেছিল। মা-বাবা শেখালে হয়তো সন্তান ভালো শিখবে না। তারপরও জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতাগুলোকে অন্যের হাতে না তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন ক্রিসটেনসন।

আজ করোনাভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্বে এক মহামারি চলছে। তার এক মূল কারণ হলো, চীনের প্রতি পুরো বিশ্বের নির্ভরতা। চীনে সবকিছু সস্তায় মেলে দেখে অনেক দেশ নিজ উৎপাদনের পেছনে সম্পদ ব্যয় না করে, বেশি লাভের উদ্দেশ্যে চীন থেকে সবকিছু আমদানি করেছে। এই মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুই সন্তানের বাবা হিসেবে হাউ উইল ইউ মেজার ইয়োর লাইফ? আমার জীবনে এক অভাবনীয় প্রভাব ফেলেছে। আশা রাখি, পাঠক হিসেবে আপনার জীবনেও ফেলবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কম্পিউটারবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার, যুক্তরাষ্ট্র