দীপকেরা হার মানেনি

দুঃসময়ে উপার্জনের পথ হারিয়েও অনেক তরুণ আস্থা রাখছেন নিজের পরিশ্রমের ওপর। ছবিটি প্রতীকী। মডেল: তাওসিফ, ছবি: সুমন ইউসুফ
দুঃসময়ে উপার্জনের পথ হারিয়েও অনেক তরুণ আস্থা রাখছেন নিজের পরিশ্রমের ওপর। ছবিটি প্রতীকী। মডেল: তাওসিফ, ছবি: সুমন ইউসুফ

কদিন আগে হঠাৎ করেই দীপক চন্দ্র বর্মণের কথা মনে পড়ল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের এই ছাত্রের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায়। বাবা ইটভাটার শ্রমিক। মেধাবী ছাত্র হিসেবে মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে বৃত্তি পেয়েছিলেন দীপক। কিন্তু টিউশনি করে যখন নিজেই কিছুটা আয় করতে শুরু করলেন, তখন বৃত্তি বাতিল করে দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল দীপকের এই ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। গত ২ ফেব্রুয়ারি তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোর স্বপ্ন নিয়ে পাতায় প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে।

সরকারি নির্দেশনায় প্রায় দুই মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। হল বন্ধ। টিউশনিতে যাওয়ার উপায় নেই। দীপক কেমন আছেন?

ফোনের ওপ্রান্ত থেকে বললেন, ‘ভালো।’ আগে আমাদের জানিয়েছিলেন, টিউশনির টাকায় শুধু নিজের হাতখরচই নয়, ছোট দুই বোনের পড়ালেখার খরচও দিতে চান তিনি। এই দুঃসময়ে কীভাবে চলছে তাঁদের পরিবার? দীপক বললেন, ‘এখন তো কোনো আয় নাই। চলে যাচ্ছে কোনোরকম। কিছু সঞ্চয় ছিল। সরকারি কিছু ত্রাণ পাইছি। ৮-১০ দিন পর ধান কাটা শুরু হলে হয়তো একটা উপায় হবে।’ অভাবের সঙ্গে লড়াইটা তাঁর বহু পুরোনো। তাই সামনে কী হবে, কীভাবে চলবে, এসব নিয়ে খুব একটা ভাবছেন না। পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে, এটাই তাঁর একমাত্র দুশ্চিন্তা।

সাহসের কমতি নেই

দীপকদের সংখ্যা কম নয়; যাঁরা পড়ালেখার পাশাপাশি আয় করেন, পরিবারের কিছু দায়িত্বও নেন নিজের কাঁধে। টিউশনি, খণ্ডকালীন চাকরি তো আছেই; গত কয়েক বছরে পাঠাও, উবার, সহজের মতো রাইড কিংবা ফুড সার্ভিসের মাধ্যমেও উপার্জনের উপায় হয়েছে শিক্ষার্থীদের। কোভিড-১৯ রোগের প্রকোপের কারণে এখন এ ধরনের প্রায় সব আয়ের পথই বন্ধ। তবে দীপকের মতো কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, তাঁরা মনোবল হারাননি। নিজের পরিশ্রমের ওপর তাঁদের আস্থা আছে।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) কৃষি অনুষদের ছাত্র মো. আল আমিনের কথাই ধরুন। তাঁর বাবা স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন। বাড়ি খুলনার কয়রায়, সুন্দরবনের কাছাকাছি। আল আমিনদের বর্গা জমি আছে। ধান কাটা, মাড়াইয়ের কাজ এবার নিজেই করছেন তিনি। বলছিলেন, ‘ধানের বড় বড় বোঝা মাথায় করে আনছি। এখনো ঘাড়ে ব্যথা।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে আল আমিনের চোখে একটা অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল। তখনই এত টাকা খরচ হয়ে গেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মতো অবস্থা ছিল না। ‘জানেন, টাকা ছিল না বলে বাড়ি থেকে সাইকেল চালায় ভার্সিটিতে ভর্তি হতে গেছি। সকাল নয়টায় রওনা দিয়ে পৌঁছছি রাত ২টায়।’ বলেন তিনি। বাবার কাছে টাকা চাওয়ার মতো অবস্থা নেই, তাই টিউশনি করে নিজের খরচ নিজেই জোটান এই তরুণ। কবে ক্যাম্পাস খুলবে, কবে আবার টিউশনিতে যাবেন, এখন সবই অনিশ্চিত। চোখে ভালো দেখতে পান না। তবু সাহস নিয়ে বললেন, ‘মনে হয় যেকোনো কাজ করতে দিলেই আমি পারব। তাই ভয় পাই না।’

ভয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষার্থী লাইজু খাতুনও পান না। করোনার কারণে তাঁর টিউশনি বন্ধ। এদিকে ট্রাকচালক ভাইয়েরও আয় নেই। সংসার চালাতে গিয়ে কদিন আগে গরু বিক্রি করে দিতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটু দূরেই লাইজুরা কয়েকজন মিলে একটা বাসা ভাড়া করে থাকেন। ২ হাজার টাকা বাসা ভাড়ার জন্য বাড়িওয়ালা বারবার ফোন করছে। এদিকে লাইজু আছেন ঝিনাইদহে, গ্রামের বাড়িতে। ঢাকায় না এলেও, ভাড়া তো দিতেই হবে। টাকার জোগান কোথা থেকে হবে জানেন না। অথচ ফোনের ওপ্রান্তে লাইজুর হাসিটা বেশ প্রাণবন্ত শোনাল। বললেন, ‘আমি তো সব সময় হাসি, সেই জন্য কেউ কেউ আমাকে “হাসি” বলে ডাকে। আর কষ্ট...সে তো ছোটবেলা থেকে করে আসছি।’

এমনই এক দুঃসময়, যখন সারা দেশের বহু মানুষ এক অভাবের চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। একদিকে লাইজু বাসার ভাড়া দিতে পারেননি, অন্যদিকে দোকানের ভাড়া পাননি বলে পরিবার নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন এক শিক্ষার্থীর সঙ্গেও কথা হলো। এই শিক্ষার্থীর পরিবার চলে দোকান ভাড়ার টাকায়। পাঠাওয়ের বাইক চালিয়ে তিনি নিজের হাতখরচ জোটান, টিউশন ফিও নিজেই দেন। ইচ্ছা ছিল এবার রমজান মাসে একটু বেশি রাইড নেবেন। আয় ভালো হলে মা-বাবা-বোনের জন্য ঈদে উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। উপহার দেওয়া না হলেও, হার তিনি মানেননি। বললেন, ‘ক্যাম্পাস তো মনে হয় আরও অনেক দিন বন্ধ থাকবে। কীভাবে কিছু আয় করা যায়, এখন সেই উপায় খুঁজতেছি।’ আলাপের শুরুতেই তিনি বলে নিয়েছিলেন, ‘আমার নাম লিখবেন না প্লিজ। বন্ধুরা তো আমার কথা জানে না। জানলে হয়তো অনেকে সাহায্য করতে চাইবে। আমি কারও সাহায্য চাই না।’