এত ভালোবাসা ও সম্মান কোথায় পেতাম?

নিলুফার মঞ্জুর
নিলুফার মঞ্জুর

সানবিমস স্কুলের অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুরের কাছে এক সাক্ষাৎকারের শুরুতেই জানতে চেয়েছিলাম, 'ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ঘিরে এত সমালোচনা কেন? জীবনে অনেক কিছুই তো করতে পারতেন। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে গেলেন কেন?'

নিলুফার মঞ্জুরের পাল্টা প্রশ্ন, 'আপনার কি মনে হয় আমি ভুল করেছি? আমি যা করেছি, ঠিক করেছি। এটা সত্য যে অনেক কিছুই করতে পারতাম, সেই সুযোগও ছিল। কিন্তু এত ভালোবাসা ও সম্মান কোথায় পেতাম?' শিক্ষক নিলুফার মঞ্জুর আরও বললেন, 'শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমি যে ভালোবাসা পাই, তা নিখাদ। এই ভালোবাসাই আমার জীবনের সেরা অর্জন। এর জন্যই জীবনভর কাজ করছি।'

গত বছরের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে নিলুফার মঞ্জুরের সাক্ষাৎকার নিই। মারা যাওয়ার খবর শোনার পর ওই সাক্ষাৎকার নেওয়ার কাহিনিটা মনে পড়ছে। সময় চেয়ে ওনাকে ফোন করেছিলাম। উনি বললেন, এখন সময় দিতে পারবেন না। একটি সম্মেলনে যোগ দিতে লন্ডন যাবেন। দু-এক দিন পর ফ্লাইট। উনি বললেন, তাজিন আপার (সানিডেলের অধ্যক্ষ তাজিন আহমেদ) সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তাঁর সাক্ষাৎকার যেন নিই, সেই পরামর্শ দিলেন। ওনাকে বললাম, তাজিন আপাই তো আপনার কথা বলেছেন। নিলুফার মঞ্জুর তখন বললেন, লন্ডন থেকে না ফিরে তিনি সাক্ষাৎকার দিতে পারবেন না। আমি বললাম, ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ২ বা ৩ নভেম্বর শিক্ষা নিয়ে বিশেষ সংখ্যা বের হবে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, 'আপনি তো নাছোড়বান্দা। তার চেয়ে মতিউর রহমান সাহেবের একটা সাক্ষাৎকার নেন। ওনাদের মতো মানুষেরা কেন তাঁদের নাতি-পুতিদের আমার স্কুলে পাঠায়, ওনারাই বরং বলুক।' বললাম, আপা, আমার সম্পাদককে আমি এ কথা কীভাবে বলি। বরং আপনি একসময় জিজ্ঞাসা করবেন। আমাকে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার হালচাল নিয়ে কিছু প্রশ্নের জবাব দেন।

নিলুফার মঞ্জুর বললেন, সম্মেলনে যে পেপার পড়তে হবে, তার প্রস্তুতি নিতে পারেননি। একপর্যায়ে তিনি বললেন, এখন দেখা করতে পারবেন না। তবে প্রশ্নগুলো পাঠাতে বললেন। উনি সুবিধামতো সময়ে জবাব দেবেন। ব্যস্ততার কারণে উনি প্রশ্নগুলোর জবাব লেখার জন্য স্কুলের একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন। ওনার ব্রিফ অনুযায়ী সেই কর্মকর্তা সাক্ষাৎকারটি লিখে পাঠান। কিন্তু এটা পড়ে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। কারণ বিশেষ সংখ্যার কাজ শেষ। হোয়াটসঅ্যাপে ওনাকে নক করি। লন্ডন থেকে তিনি জানালেন, সম্মেলন শেষ। স্বজনের কাছে আছেন। সম্ভবত অক্টোবরের শেষ দিন দেশে ফেরার কথা বললেন। ওনাকে বললাম, কয়েকটি প্রশ্নের জবাব আরেকটু বোঝা প্রয়োজন, আপনার ব্রিফ অন্যরা হয়তো ঠিকমতো লিখতে পারেননি। উনি বললেন, ১ নভেম্বর দেশে ফিরবেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে ফোন করবেন। আমি ওনাকে আর ফোন করি না। অপেক্ষায় থাকি, কখন উনি ফোন করেন। এদিকে বিশেষ সংখ্যার মেকআপ শেষ। আমার জন্য ৮০০ শব্দ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ওনার ছবি বসিয়ে জায়গা খালি রাখা হয়েছে। আমি সানবিমসের ব্যবস্থাপক কাদের ভাইকে ফোন করে অধ্যক্ষের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করি।

১ নভেম্বর রাতে নিলুফার মঞ্জুর আমাকে ফোন করেন। পুরোনো সাক্ষাৎকারের কপি হাতে নিয়ে নতুন করে ওনার বক্তব্য যুক্ত করি। ফোনে দীর্ঘ সময় কথা হয়। একপর্যায়ে উনি বললেন, 'আপনি তো নতুন আরেকটি সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেললেন।' ওনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করি কষ্ট দেওয়ার জন্য।

কথা শেষে সাক্ষাৎকার লিখতে গিয়ে দেখি, অনেক কথা বলেছি। সাক্ষাৎকার দেড় হাজার শব্দ পার হয়ে গেছে। কিন্তু বিশেষ সংখ্যায় এই সাক্ষাৎকারের জন্য বরাদ্দ ৮০০ শব্দ। মনটা খারাপ হয়ে যায়। পাতার মেকআপও শেষ। নড়চড় করার সুযোগ নেই, সময়ও শেষ হয়ে গেছে। শেষ সময় এই লেখা কেউ কাটাকাটি করতে রাজি নয়। সেই নিষ্ঠুর কাজটি আমাকেই করতে হয়। প্রায় দেড় হাজার শব্দ ৮০০ শব্দ করে পাঠাই। এটাই ছাপা হয়।

বিশেষ কারণে প্রথম আলো ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান করেনি। কিন্তু বিশেষ সংখ্যার লেখকদের সম্মানে ঘরোয়া অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। ওই অনুষ্ঠানে আসতে নিলুফার মঞ্জুরকে আমন্ত্রণ জানাই। ওনার ব্যস্ততা ছিল। পীড়াপীড়ি করলাম। বললেন, আসবেন। অনুষ্ঠানে এসে বেশ খুশি হলেন মনে হয়। অনুষ্ঠান শেষে ওনাকে সিএ ভবনের নিচে নেমে গাড়িতে তুলে দিই। যাওয়ার আগে ঘাড়ে হাত দিলেন, স্নেহ ও আশীর্বাদের হাত। বললেন, একদিন আগে সময় নিয়ে স্কুলে যেতে। অনেক কথা বলবেন। কিন্তু সেসব কথা আর শোনা হয়নি।
সাড়ে চার দশকের বেশি সময় আগে নিলুফার মঞ্জুর প্রতিষ্ঠা করেছেন সানবিমস স্কুল। এই প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সানবিমস স্কুলের এত চাহিদা, কিন্তু এত কম শিক্ষার্থী নেন কেন? আপনি তো চাইলে ১০-২০টি শাখা খুলতে পারেন। জবাবে নিলুফার মঞ্জুর বলেছিলেন, 'শাখা খোলা ও ছাত্র পাওয়া ব্যাপার না। কিন্তু সেটা করলে মান ধরে রাখা যাবে না। এটি ম্যানেজ করাও বড় ব্যাপার। আমি এটাকে সেবা হিসেবে নিয়েছি, বাণিজ্য হিসেবে নেইনি।'

ব্রিটিশ কারিকুলামে 'ও' লেভেল এবং 'এ' লেভেল পড়ানো হয় প্রতিষ্ঠানটিতে। তিন বছরের বেশি বয়সী শিশু সেখানে ভর্তি হয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হলেও সানবিমসে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা, বাংলাদেশ স্টাডিজ ও গণিত বাধ্যতামূলক বিষয়।

স্কুলের লোগোতে সাতটি সূর্যকিরণ বা সূর্যরশ্মি। এগুলো হচ্ছে: জ্ঞান, নেতৃত্ব, দেশপ্রেম, সততা, নম্রতা, আত্মবিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি। এই সাতটি মানদণ্ড সানবিমসের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বিশ্ব নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করবে—এটাই বলা আছে স্কুলের ওয়েবসাইটে।

স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা এখন প্রায় ১১০০। শিক্ষক আছেন ১৬১ জন এবং কর্মীর সংখ্যা ৮১। উত্তরায় স্কুলের মূল ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ৭০০ এবং ধানমন্ডিতে ৪০০। ধানমন্ডি শাখায় প্লে থেকে চতুর্থ শ্রেণি এবং উত্তরায় প্লে থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। উত্তরা ও ধানমন্ডির তিনটি শাখায় প্রতিবছর প্লে গ্রুপে আবেদন পড়ে হাজার হাজার, কিন্তু ২৫টি করে মোট ৭৫টি শিশু ভর্তির সুযোগ পায়।

নিলুফার মঞ্জুরের ব্যক্তিত্ব, তাঁর অবদান এবং শিক্ষার প্রতি অনুরাগ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, 'এখন তো আমার স্কুলে দ্বিতীয় প্রজন্ম আসছে। প্রথম দিকে যারা আমার ছাত্র ছিল, তাদের ছেলেমেয়েরা এখন আসছে। সাবেক ছাত্র বা ছাত্রী যখন তার সন্তানকে আমার কাছে ভর্তির জন্য নিয়ে আসে, তখন অনেক ভালো লাগে। আবার খুবই খারাপ লাগে যখন কাউকে নিতে পারি না। কারণ আমি তো এক শাখায় ২৫ এবং তিন শাখা মিলে ৭৫ পার করব না।'

আপনার সাবেক শিক্ষার্থী এবং এখনকার শিক্ষার্থীর মধ্যে কী পার্থক্য দেখেন? নিলুফার মঞ্জুর বলেন, 'বাবা-মায়েদের সঙ্গে তাদের সন্তানদের একটি বড় পার্থক্য খুঁজে পাই; তাহলো, এখনকার প্রজন্ম আগের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। দ্বিতীয় প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি, চাহিদা ও প্রয়োজন অনেক বদলে গেছে। তারা বিশ্ব নাগরিক হতে চায়।'

শরিফুজ্জামান, হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো
pintu. dhaka@gmail. com

আরও পড়ুন: