প্রিয় অধ্যক্ষের জন্য শোকগাথা

নিলুফার মঞ্জুর
নিলুফার মঞ্জুর

মিসেস মঞ্জুরকে আমি প্রথম দেখি ২০০২ সালের কোনো একদিন। ইন্টারভিউ দিতে বসতে হয়েছিল তাঁর সামনে। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হওয়ার জন্য লিখিত পরীক্ষা দিয়েছি, তাতে উত্তীর্ণ হয়েছি, এবার মৌখিক পরীক্ষা। ইন্টারভিউ। নতুন কারও সামনে আমি কখনোই সহজ হতে পারি না, এই স্বভাব এখনো ছাড়তে পারিনি। ওই ইন্টারভিউয়ে আমি যা করি, তাকে বলা যায়, নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা। আমার বয়স সাত, আমার মনে আছে, মিসেস মঞ্জুর আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, আমি কোন ধরনের বই পড়তে পছন্দ করি, এই স্কুলে আমি কিসে চড়ে এলাম—সোজা প্রশ্ন, উত্তর তো আমার জানাই। কিন্তু তখন, ওইখানে আমার বাবা আর মাকে পাশে রেখে আমি যা করলাম, তা হলো, আমি একদম চুপ করে গেলাম, আমার মুখে থেকে একটা শব্দও বের হলো না।

আমার মনে হয়, মিসেস মঞ্জুর মানুষটা কেমন, এই একটা ঘটনা থেকে তা অনেকটা আঁচ করা যায়। আমাদের দেশে যে আজব প্রথা আছে, ছোট্ট বাচ্চাদের বড় বড় ইন্টারভিউর মুখোমুখি হতে হয়, তিনি তার মধ্য দিয়ে খাঁটি জহুরির মতো বের করতে ফেলতে পারতেন কার মধ্যে কী সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। আমার ধরনধারণ কেমন, সেটা পুরো স্কুল জেনে গেল, তার মধ্য দিয়ে আমি আমার চান্স পাওয়ার সুযোগটা বোমা মেরে উড়িয়ে দিলাম, তা সত্ত্বেও আমাকে সানবিমস স্কুলে ভর্তি করে নেওয়া হলো। সেই থেকে আমি আমার ক্লাসে ভালো করার জন্য খুবই পরিশ্রম করতাম। কারণ আমার সম্পর্কে, হয়তো ভালোভাবেই একটা উচ্চ ধারণা তিনি পোষণ করেছিলেন, আমার প্রতি বিশ্বাস রেখে তিনি আমাকে নিয়েছিলেন তাঁর স্কুলে, যে স্কুল গড়ে তোলার জন্য তাঁকে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়েছে।

এমন না যে রোজই আমাদের সঙ্গে মিসেস মঞ্জুরের দেখা হতো। আমাদের সারা দিনে মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল কে কী টিফিন আনল, সর্বশেষ পরীক্ষায় কে কত নম্বর পেল, কিংবা স্কুল বাসে কী করে নিষিদ্ধ গ্যাজেটগুলো শিক্ষকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটুখানি বের করা যায়! তা সত্ত্বেও স্কুলে তিনি ছিলেন সর্বত্র ও সদা বিরাজমান।

মিসেস নীলুফার মঞ্জুর প্রায় প্রতিটা অ্যাসেম্বলিতে হাজির থাকতেন; তিনি আমাদের জানাতেন জরুরি ব্যাপারগুলো, হতে পারে সেই দিনের গুরুত্বপূর্ণ খবর, কিংবা মনে করিয়ে দিতেন কতগুলো ছোটখাটো জিনিস, যা আমাদের মানুষ হতে সাহায্য করবে। সূর্যের সাতটা রশ্মি, সেই সাত রশ্মি সাতটা মূল্যবোধের প্রতীক, সেই মূল্যবোধ সাতটার আলো দিয়ে তিনি আমাদের হৃদয়টাকে চিরস্থায়ীভাবে আলোকিত করে দিতে চাইতেন। এগুলো হলো: জ্ঞান, নেতৃত্ব, দেশপ্রেম, সততা, বিনয়, আত্মবিশ্বাস এবং অঙ্গীকার। আজও আমি এই সাতটা মূল্যবোধ মনে করতে পারছি (হয়তো কয়েক মিনিট মাথাটা একটু ঘামিয়ে নিতে হয়েছে)। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি এই মূল্যবোধগুলো নিজের জীবনে চর্চা করতে।

প্রথম সাক্ষাতের পর থেকে তিনি আমাকে একবারের জন্যও ভোলেননি। আমাদের প্রথম সাক্ষাৎটা অবিস্মরণীয় কিছু ছিল না। আমার মা-বাবা আর মিসেস মঞ্জুর সম্ভবত স্বীকার করবেন যে ওই সাক্ষাৎকার ছিল ভুলে যাওয়ার মতোই একটা ঘটনা। কিন্তু তিনি আমাকে মনে রেখেছেন, তার কারণ, এরপর থেকে তো আমি সানবিমসের শিক্ষার্থী। আর মিসেস মঞ্জুর সানবিমস পরিবারের প্রতিটা সদস্যের জন্য আলাদা আলাদা করে সময় দিতেন এবং প্রত্যেককে করে তুলতেন তাঁর নিজের পরিবারের সদস্য। বানিয়ে ফেলতেন তাঁর হৃদয়েরই একটা অংশ।

প্রতিবার আমার কিংবা আমার মা-বাবার সঙ্গে যখনই তাঁর দেখা হতো, তিনি জিজ্ঞেস করতেন, আমরা কেমন আছি। কী করে পারতেন তিনি জানি না। আমার খুঁটিনাটি সব খবরই থাকত তাঁর নখদর্পণে। আমার সবকিছু যাতে ঠিকঠাক থাকে, সে জন্য সময় দিতেন তিনি। আমি দেখেছি, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বিয়ের ছবিতে তাঁর উপস্থিতি; যেই আমন্ত্রণ করত, তিনি উপস্থিত হতে ভুল করতেন না। শিক্ষার্থীরা যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চাইলেই তিনি তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতেন। যখন কোভিড-১৯–এর প্রকোপ সবে শুরু হচ্ছে, তিনি প্রতিটা ছাত্রকে মেসেজ পাঠালেন, তারা যেন সবাই নিরাপদে থাকে এবং এই আশাবাদও ব্যক্ত করলেন, যখন এই দুর্যোগ কেটে যাবে, তখন তারা আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরবে।

আমরা একটা নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বাস করছি। যে বৈশ্বিক মহামারির বিরুদ্ধে তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তা-ই তাঁর জীবন কেড়ে নিল। কিন্তু আমরা তো কেবল তাঁর চলে যাওয়া নিয়ে শোক করব না। মিসেস মঞ্জুরের জীবন ছিল এমনই আলোকময় যে আমরা বহু দশক ধরে তা উদ্‌যাপন করব।

বলা হয়, ‘একবার যে বিমার, সে চিরটা কাল বিমার’, একবার যে সানবিমসে পড়েছে, সে চিরটাকাল সানবিমসেরই থেকে যায়। আট বছর আগে আমি সানবিমস ছেড়েছি। কিন্তু একটা দিনও যায় না, যেদিন আমি আমার কোনো পুরোনো সহপাঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি, কিংবা সেই ধূসর-সাদা রঙের স্কুল ইউনিফরম পরা ছবি বের করে দেখিনি। কিংবা সূর্যের সাতটা আলোকরশ্মির অন্তত একটা নিজ জীবনে প্রতিফলিত করার জন্য কঠোরতম শ্রম স্বীকার করিনি। একটা দিনও সত্যি যায় না, যেদিন আমি চেষ্টা করি না সততা, কিংবা দেশপ্রেমের আদর্শ নিজের জীবনে অনুশীলন করতে।

মিসেস নীলুফার মঞ্জুর আমাদের ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু তারও চেয়ে বড় কথা, তিনি যে আদর্শের ওপর ভিত্তি করে সানবিমস প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তিনি চাইতেন সেই আদর্শ ও মূল্যবোধগুলো আমাদের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হোক। আমরা যেন সেসব ধারণ করি, যাতে আমরা কেবল সানবিমস স্কুলকে গর্বিত করতে পারি, তা-ই নয়, গৌরবান্বিত করতে পারি পুরো জাতিকে।

আমরা ধরে নিই যে আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলো চিরদিনই বেঁচে থাকবে। যখনই আমি তাঁর চলে যাওয়ার খবর শুনলাম, তারপর থেকে আমি আমার বন্ধুদের বলছি, যেসব মানুষ কোনো দিনও মারা যাবেন না বলে আমরা মনে করি, মিসেস মঞ্জুর ছিলেন সেই ধরনের একজন মানুষ। তার কারণ বহুভাবে তিনি মৃত্যুর ঊর্ধ্বে। নীলুফার মঞ্জুর-উত্তর সময়ে সানবিমসের করিডর দিয়ে যে শিক্ষার্থীরা হাঁটবে, তারা শুনবে এক কিংবদন্তির গল্প। তিনি যেসব গুণাবলি এবং মূল্যবোধের ওপরে জোর দিতেন, তারা বড় হবে সেসব অর্জনের চেষ্টার মধ্য দিয়ে। তাঁর মতো একজন শক্তিমান নারী, প্রেরণাদায়ী নেতা এবং যুগোত্তীর্ণ শিক্ষাবিদের সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম, এর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমার নেই।

ধন্যবাদ, মিসেস নীলুফার মঞ্জুর, আপনার অভাব আমরা সারাক্ষণ অনুভব করব, কিন্তু আপনাকে আমরা কখনোই ভুলব না।

পদ্য পারমিতা: সানবিমস স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। বর্তমানে ডিজিটাল কনটেন্ট স্পেশালিস্ট, ইনজিনিয়াস প্রেপ, যুক্তরাষ্ট্র।