জুপিটারের সেই ছাত্রী

বিভাগের ‘ভার্চ্যুয়াল গ্র্যাজুয়েশন’ অনুষ্ঠান। বিভাগীয় প্রধান ঘোষণা দিলেন, ‘এই বছরের শ্রেষ্ঠ সিনিয়র হচ্ছে মলি (ছদ্মনাম)।’ তারপরে মলি কোন ক্লাবের প্রধান ছিল, কী কী পুরস্কার পেয়েছে, পড়াশোনা শেষে কোথায় কাজ করবে—বৃত্তান্ত চলল কয়েক মিনিট।

মলিকে পুরস্কার দেওয়ার পর্ব শেষ। এখন পরবর্তী আলোচ্যসূচি। যেহেতু ভিডিও চ্যাটে সবকিছু হচ্ছে, নিজের মাইক্রোফোনটি চালু করে মাইকটির দখল নিলাম।

মলির একাডেমিক অ্যাডভাইজর ছিলাম আমি। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিল আমার অফিসের সামনে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বাড়ি কোথায়?’

মলি: আজ্ঞে, জুপিটারে।

বুঝলাম, ফাজলামো করছে আমার সঙ্গে।

‘বটে?’ বলে গুগল ম্যাপসে গেলাম। ‘বাসার অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ দাও। এক্ষুনি খুঁজে বের করি,’ ভাবছিলাম ফাজলামো করার সাজা দেব।

পরে বুঝলাম যে ফাজলামো করছে না। সত্যি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে জুপিটার বলে একটা শহর আছে। দুজন মিলে অনেকক্ষণ হো হো করে হাসলাম । ম্যাপসে ও দেখাল, জুপিটারের এক বাতিঘর (লাইট হাউস)। ওখানে উঠলে নাকি দেখা যায় সাগর এবং দিগন্তের সংমিশ্রণের এক মনোরম দৃশ্য।

২০১৮ সালের ঘটনা। সব ক্লাসে মলির ফল বেশ খারাপ। চিন্তিত হয়ে অফিসে ডাকলাম। জানাল যে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দুই সপ্তাহ আগে মারা গেছেন ওর মা। কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছে না, পড়াশোনায় তো একদমই নয়। অনেক সময় নিয়ে সেদিন কথা বলেছিলাম ওর সঙ্গে।

পড়াশোনা করার মাঝে ক্যানসারে আমিও আমার মাকে হারিয়েছি । তাই হয়তো কিছুটা হলেও বুঝতে পারছিলাম ওর মানসিক অবস্থা।

ভিডিও চ্যাটের মাইক্রোফোনটা তখন আমার হাতে। শ্রোতা হিসেবে আছেন কয়েক শ শিক্ষাথী, তাঁদের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন। বিভাগীয় প্রধান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। চাহনির অনুবাদ করলে এ রকম শোনাবে,‘ইউ বেটার হ্যাভ সামথিং ইম্পর্টেন্ট টু সে’ (আশা করি তোমার গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার আছে)।

‘মলির শিক্ষাজীবন ছিল খুবই বর্ণিল।’ নীরবতা ভেঙে আমি বলা শুরু করলাম। ‘ডিগ্রির মাঝখানে সে তার মাকে হারিয়েছে। মা হারানোর অসহনীয় বেদনা তাকে লম্বা সময় ভুগিয়েছে। তারপরেও সে চেষ্টা করে গেছে। বীরদর্পে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী হিসেবে ডিগ্রি শেষ করছে। আজ ওর মা যদি আমাদের মাঝে থাকতেন, খুবই গর্ব বোধ করতেন।’

বলেই বোধ হলো, ‘এত আনন্দঘন এক মুহূর্তে এই কথা বলে আমি কি সবার আনন্দ মাটি করলাম?’

মলির উপস্থিত বুদ্ধি খুবই প্রবল। সে দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নিয়ে সুদৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘আমারও তাই ধারণা, স্যার।’

সেদিন রাতেই মলির লম্বা ই–মেইল। বার্তার কিছু অংশের বাংলা অনুবাদ জুড়ে দিলাম নিচে। একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের কৃতজ্ঞবার্তা আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।

‘গ্র্যাজুয়েশনে আপনার কথাগুলোর জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আপনি যে আমার মাকে স্মরণ করেছেন, আমার প্রতিকূল সময় পেরিয়ে আসার কথা বলেছেন, এটা আমার, আমার বাবা ও আমার বোনের জন্য অনেক বড় ব্যাপার। আপনার কাছে অনেক কিছু শিখেছি। আপনার সমানুভূতি (এমপ্যাথি) এবং কম্পিউটারবিজ্ঞানের (সিএস) মাঝেও মানবিকতা খোঁজার যে চেষ্টা, তা সিএসের স্নাতক হিসেবে আমাকে গর্বিত করেছে।’

মলি আমার ক্লাসে প্রোগ্রামিংয়ের একটি প্রকল্পে কম নম্বর পেয়েছিল। সমালোচনা করে লিখেছিলাম, ‘সি প্লাস প্লাসে তুমি এখনো কাঁচা রয়ে গেলে।’ তবে এ নিয়ে আমি বেশি চিন্তিত নই। সততা, সহমর্মিতা, নিয়মানুবর্তিতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবন এখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কৃত্রিম মানদণ্ডের ঊর্ধ্বে।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারের কম্পিউটারবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক