শিক্ষার অগ্রগতি ধরে রাখা হবে বড় চ্যালেঞ্জ

ড. মনজুর আহমদ
ড. মনজুর আহমদ

করোনা অতিমারি থেকে কবে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, বলা যাচ্ছে না। হয়তো স্বল্পতর প্রকোপে করোনা দীর্ঘদিন আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকবে। ইতিমধ্যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেই আদলে নতুন বাজেট তৈরি হবে। অর্থনীতির সঙ্গে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতকেও উদ্ধার করতে হবে। পুনরুদ্ধার বলছি না; কারণ, করোনা–পূর্ববর্তী স্থিতাবস্থায় ফিরে যাওয়া এ ক্ষেত্রে কাম্য নয়।

গণসাক্ষরতা অভিযানের পক্ষে মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে পর্যন্ত শিক্ষাসেবায় নিয়োজিত ১১৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ১১টি শিক্ষক সংগঠনকে নিয়ে বর্তমান সংকটে শিক্ষাসেবা সম্বন্ধে তাদের ধারণা বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাসেবা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর শঙ্কা, উদ্বেগ ও দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয়ের ঝুঁকির কথা প্রকাশ পেয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার, অনিয়মিত উপস্থিতি, শিশুশ্রম বৃদ্ধি, বাল্যবিবাহ, পরিবারে শিশু ও নারী নির্যাতন, খাদ্যাভাব ও পুষ্টিহীনতা শিক্ষাসেবার জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

গত দুই দশকে শিক্ষায় অগ্রগতি হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে মহামারির অভিঘাতে। ইউনেসকো থেকেও এই আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। জীবন ও জীবিকা—উভয়ই এখন বিপন্ন। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা ২০ শতাংশ মানুষের সংখ্যা এখন অন্তত দ্বিগুণ হয়েছে বলে অনুমান করছেন গবেষকেরা। মানসিক শঙ্কা, ভীতি ও হতাশায় আক্রান্ত শিশু, তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকেরাও। 

সিলেবাস ও বার্ষিক পাঠ সমাপন, পরীক্ষা নেওয়া, কোচিং-টিউটরিংসহ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি—এই দৈনন্দিন রুটিনে ফিরে যাওয়াই কি এখন প্রধান করণীয়? বছরের এক বড় অংশজুড়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে না। শিক্ষার্থীসহ পুরো সমাজ এক দুর্যোগে বাস করছে। এই দুর্যোগের প্রভাব অনির্দিষ্টকাল চলবে। 

আগামী দুই থেকে তিন শিক্ষাবর্ষের শিক্ষা উদ্ধার পরিকল্পনায় প্রধান কাজ হবে সব শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে এনে ধরে রাখা, ঝরে পড়া ও অনিয়মিত উপস্থিতি রোধ করা, পাঠদানে যে ক্ষতি হয়েছে তা ক্রমশ পুষিয়ে দেওয়া, যে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়েছে, তাদের অতিরিক্ত সহায়তা দেওয়া, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আশ্বস্ত করা, উৎসাহ দেওয়া, শিক্ষকদেরও আশ্বস্ত করা এবং তাঁদের বেতন-পারিতোষিক নিশ্চিত করা। বিদ্যালয়ভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষকদের অতিরিক্ত সেবাদানে প্রণোদনাসহ উদ্বুদ্ধ করা। 

পরীক্ষা নেওয়া এবং সে জন্য আয়োজন ও প্রস্তুতি প্রকৃত শিক্ষণ-শিখনের বিকল্প নয়। পরীক্ষার জন্য চাপ সৃষ্টি না করে শেখা-জানা এবং জ্ঞান ও দক্ষতার চর্চায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করাই হবে এখন প্রধান কাজ। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পরবর্তী পাবলিক পরীক্ষা স্থগিত করে রাখলে আকাশ ভেঙে পড়বে না। দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষাও সীমিত পরিসরে মূল দক্ষতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে স্বল্প সময়ে নেওয়া যেতে পারে। ইংল্যান্ডে জিসিই পরীক্ষা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদানের কার্যক্রম ভালো উদ্যোগ। কিন্তু অর্ধেক পরিবারই টেলিভিশনের আওতায় নেই। তা ছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু প্রযুক্তিভিত্তিক পাঠদান কার্যকর হয় না। এ জন্য প্রযুক্তি ও শ্রেণিভিত্তিক পাঠের সমন্বয় ও শিক্ষকদের মধ্যস্থ ভূমিকা প্রয়োজন। 

টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি), মোবাইল ফোন কোম্পানি, এটুআই প্রকল্প ও শিক্ষা কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্রডব্যান্ডসহ বিনা মূল্যে ওয়াই-ফাই সংযুক্তির উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ট্যাবলেট কম্পিউটারের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক ও অন্য শিক্ষণসামগ্রী হাতের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও সম্ভব। শিক্ষা উদ্ধার ও ভবিষ্যতের নতুন স্থিতাবস্থার জন্য সম্পদ প্রয়োজন। নতুন বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ শিক্ষা উদ্ধার এবং নতুন স্থিতাবস্থার সূচনার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। 

সম্পদের যথার্থ জবাবদিহিমূলক ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা আশাপ্রদ নয়। প্রতি উপজেলা ও ইউনিয়নে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট এনজিও, অভিভাবক ও স্থানীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার ও শিক্ষা কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে শিক্ষা উদ্ধার কার্যসূচি প্রণয়ন ও তত্ত্বাবধান কমিটি গঠিত হতে পারে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির নীতি মেনে এই কমিটিকে কাজ করতে হবে। 

আশা করছি, শিক্ষার জন্য সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অপব্যয় রোধ করে অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষা বরাদ্দের একটি অংশ—পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গড়ে প্রতি উপজেলার জন্য ১০ কোটি টাকা প্রস্তাবিত শিক্ষা উদ্ধার কমিটির তত্ত্বাবধানে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট এনজিওগুলোর মাধ্যমে কাজে লাগানো যেতে পারে। এই ব্যয় প্রচলিত সরকারি ক্রয়নীতির গতানুগতিক ধারায় হবে না। কারণ, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এই প্রক্রিয়ায় এনজিওগুলোর ব্যবহার মোটেই দুর্নীতিমুক্ত নয়। 

এ ক্ষেত্রে দেশের শিক্ষা এনজিওগুলোর ফোরাম গণসাক্ষরতা অভিযানকে যুক্ত করে ব্র্যাক, ঢাকা আহছানিয়া মিশন, আরডিআরএসের মতো সুপরিচিত ও দক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। তারা প্রতি উপজেলায় সহযোগী স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করে অর্থের উপযুক্ত ব্যবহার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারবে।

অভূতপূর্ব সংকট ও অস্থিরতার সময়ে কিছু ব্যতিক্রমী ভাবনা-প্রক্রিয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। 

 (নিবন্ধে প্রাপ্ত মতামত লেখকের নিজস্ব)

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়