পড়ালেখায় সততা প্রমাণের সুযোগ এখন

>বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইনে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে ছেলেমেয়েদের ক্লাস নাহয় নেওয়া গেল, কিন্তু মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অনেকে চিন্তিত। অনেক শিক্ষার্থী যেখানে পরীক্ষার হলে শিক্ষকের কড়া নজরে থাকা সত্ত্বেও অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ খোঁজে, সেখানে অনলাইনে পরীক্ষা হলে পরীক্ষার মান নিশ্চিত হবে তো? দিন শেষে সেই মান রক্ষার দায়িত্ব আসলে শিক্ষার্থীদেরই। এ প্রসঙ্গে লিখেছেন ইউনিভার্সিটি অব উলংগং ইন দুবাইয়ের সহকারী অধ্যাপক জিনাত রেজা খান। দীর্ঘদিন তিনি পড়ালেখায় নৈতিকতা বিষয়ে গবেষণা করেছেন।

সাধারণ নিয়মে শ্রেণিকক্ষে পরীক্ষা হলে শিক্ষার্থীরা যতটা নকল করে, সেই তুলনায় অনলাইনে পরীক্ষার ক্ষেত্রে নকল কিন্তু বাড়ে বা কমে না। আমি জানি, শুনতে একটু অদ্ভুত লাগছে। কিন্তু গবেষণায় বারবারই এটি সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারি যখন সারা পৃথিবীকে হুমকির মুখে ফেলে দিলে লকডাউন শুরু হলো, আমরা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কথা বললাম, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দূরশিক্ষণ নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। সেই সঙ্গে শিক্ষাবিদেরা ভাবতে শুরু করলেন, দূরশিক্ষণ চালু হলে শিক্ষার্থীরা ফাঁকি দিতে শুরু করবে না তো? তাঁদের মূল্যায়নের পদ্ধতি কীভাবে নিখুঁত হবে?

সত্যি কথা হলো, অসদুপায় অবলম্বন যেকোনো ধরনের শিক্ষার মান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষার জন্যই একটা বড় হুমকি। শিক্ষার্থীরা যদি অসদুপায় অবলম্বন করে পার পেয়ে যায়, তখন তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো সাধারণত স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ থেকে আসা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা, পড়ালেখার মান, নৈতিকতা নিয়ে সন্দিহান থাকে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসদুপায় অবলম্বনের হার বেশি, গবেষণাও তা-ই বলে।

এখন তুমি ভাবতে পারো—সবাই তো কোনো না কোনো অসদুপায় অবলম্বন করছে। যদি আমি না করি, তবে পিছিয়ে পড়ব। অন্যরা যেখানে অসদুপায় অবলম্বন করছে, সেখানে আমি না করলে কী-ইবা যায় আসে।

ঠিক আছে, মানলাম।

কিন্তু মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের কথা ভাবো। তিনি একাই একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন। একজন মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস বদলে দিয়েছেন।

মহাত্মা গান্ধীর কথা ভাবো। একজন মানুষই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতায় বড় ভূমিকা রেখেছেন, অথচ কখনো বন্দুক হাতে নেননি।

কখনো কখনো একজন মানুষই যথেষ্ট।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজের কথা ভাবো।

যখন তুমি কোনো অসদুপায় অবলম্বন করছ, তখন মনের অজান্তেই নিজেকে বলছ, তুমি আসলে যথেষ্ট উপযুক্ত নও, বুদ্ধিমান নও। নিজের সক্ষমতার ওপর তোমার আস্থা নেই, সে রকম জ্ঞান নেই। বহু গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে, যেসব শিক্ষার্থী অসদুপায় অবলম্বন করে, তাদের মানসিকতা ধীরে ধীরে এমন হয়ে যায়।

তুমিই ভবিষ্যৎ। আজ তুমি পড়ালেখা করছ, কাল তুমিই নীতি নির্ধারণ করবে, জীবন বদলে দেওয়া সিদ্ধান্ত নেবে, হয়তো দেশের নেতৃত্বও দেবে। আশপাশে সবাই করছে বলেই ‍তুমি এই দুর্নীতিকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়ো না। দুর্নীতি, সেটা যে ধরনেরই হোক না কেন, যখনই আমরা মনে মনে এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিই, সেখান থেকেই অসততা, মিথ্যা, চুরির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। অতএব সিদ্ধান্ত তোমার।

শিক্ষকেরা পুলিশ নন, আর তুমিও চোর নও। যখন একা বসে পরীক্ষা দিচ্ছ, কেউ তোমাকে দেখছে না। এটাই নিজের কাছে প্রমাণ করার সুযোগ যে তুমি আশপাশের সবার মতো নও। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে। তাদের ওপর যে মানসিক চাপ, সেটা কল্পনাতীত। কোভিড–১৯–এর এই দুঃসময়ে তারা ব্যক্তিগত জীবন এবং পড়ালেখার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকে ভাবছে এই অনলাইনের পড়ালেখাটা কেমন হবে, পরীক্ষা কেমন হবে, এটা তাদের জিপিএর ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ভাবছে না যে কীভাবে এই নতুন পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়, বরং ভাবছে কীভাবে এটা পার করা যায়।

এটাই সত্যি।

কোভিড–১৯–এর এই মহামারির সময় তোমার ভূমিকা কী ছিল, ছোটরা কী মনে রাখবে, বড়রা কী বলবে—দিন শেষে এসব নির্ভর করছে তোমার ওপর।

তুমি কি সেই প্রজন্ম হবে, যারা অসদুপায় অবলম্বন করে কোনোমতে পার পেয়ে গেছে? নাকি সেই প্রজন্ম, যারা সত্যিকার সাহস, মেধা, বুদ্ধি, সততা দিয়ে নিজেদের আলাদা প্রমাণ করেছে?

ইতিহাস গড়ো। আরও ভালো হও।