প্রকৃত শিক্ষা বনাম সনদভিত্তিক শিক্ষা

অমিত চাকমা। ছবি: সংগৃহীত
অমিত চাকমা। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষা বলতে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সনদভিত্তিক শিক্ষাকেই বোঝাতে চাই। প্রকৃত আর সনদভিত্তিক শিক্ষা—দুটিই আমাদের প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে একজন শল্যবিদ বা সার্জনের কথা ধরা যাক। একজন সার্জনকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রায় এক দশক পড়ালেখা করতে হয়, ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এই দীর্ঘ প্রশিক্ষণ অস্ত্রোপচারের কাজে তাঁকে দক্ষ করে তোলে। যেহেতু সার্জনের ওপর রোগীর জীবন-মৃত্যু নির্ভর করে, দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ সনদের মাধ্যমে তাঁর যোগ্যতার আশ্বাস দেন। কিন্তু তিনি প্রকৃত শিক্ষায় কতটা শিক্ষিত হয়েছেন, সনদ সেই নিশ্চয়তা দিতে পারে না।

ভাষার দক্ষতা, সংখ্যা নিয়ে কাজ করার দক্ষতা, আইডিয়া বা ধারণা প্রকাশ করতে পারার ক্ষমতা মৌলিক শিক্ষার ন্যূনতম উপাদান মাত্র। জ্ঞান অর্জনের জন্য এসব বুনিয়াদি সরঞ্জাম। সত্যিকার শিক্ষিত হওয়ার জন্য এগুলো প্রয়োজনীয়, তবে পর্যাপ্ত নয়। শিক্ষিত মানুষ হওয়ার জন্য এসবের চেয়েও বেশি প্রয়োজন মানবতার শিক্ষা।

আমার খুব প্রিয় একটা প্রবাদ হলো, ‘মন একটা প্যারাসুটের মতো, খোলা থাকলেই ভালো কাজ করে।’ আমরা সবাই মুক্তমন নিয়ে জন্ম নিই। পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে ধীরে ধীরে আমাদের মন পক্ষপাতমূলক ধারণায় বন্দী হতে থাকে। সত্যিকারের শিক্ষা আমাদের এই পক্ষপাতদুষ্ট চিন্তাধারা ভেঙে দিয়ে নির্দ্বিধায় ভাবার ক্ষমতা দেয়।

মানবতার একটি মৌলিক প্রশ্ন, ‘ভালো আর মন্দ’ নিয়ে আমরা হাজার বছর ধরে ভাবছি। ইউরোপের সক্রেটিস, চীনের কনফুসিয়াস, ভারতীয় উপমহাদেশের গৌতম বুদ্ধসহ অনেক মহান দার্শনিক ভালো আর মন্দের অর্থ অনুসন্ধানে ব্রত ছিলেন। তাঁদের দর্শন ও ভাবনা বিভিন্ন সভ্যতার রূপ দিয়েছে। তাঁদের শিক্ষার প্রভাবে আমাদের চিন্তাধারার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। ভালো-মন্দ যাচাই করার ক্ষমতা আছে বলেই মানব জাতি অন্য যেকোনো প্রজাতির চেয়ে আলাদা।

ভালো-মন্দ বিচারের ধারণা থেকেই এসেছে নৈতিকতার শিক্ষা। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শাখায় নৈতিকতা শেখানো হয় না। আমার মতে, ‘নৈতিকতার শিক্ষা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। নয়তো শিক্ষার্থীদের নিজেদেরই নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণে উদ্যোগী হওয়া উচিত। পেশাজীবনে আমি বহু নৈতিক ব্যর্থতা দেখেছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপমহাদেশের শিক্ষার্থীদের তো বটেই, এমনকি সমাজের উচ্চ আসনে আসীন ব্যক্তিদের নৈতিক মান ও এর প্রয়োগ তুলনামূলক দুর্বল বলে মনে হয়।

উদাহরণ দিই, বাংলাদেশের অনেকেই সন্তানকে কানাডাসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশে পড়তে পাঠান। এখানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি সে দেশের শিক্ষার্থীদের তুলনায় তিন–আট গুণ বেশি। প্রকৌশল বিষয়ে পড়ার বার্ষিক ফি ৪০ হাজার ডলারেরও বেশি। থাকা-খাওয়া ও আনুষাঙ্গিক ব্যয় মিলে মোট খরচ পড়বে ন্যূনতম ৬০ হাজার ডলার বা ৫০ লাখ টাকার বেশি। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা সন্তানদের এখানে পড়তে পাঠান, তাঁদের কেউ কেউ উচ্চ ও মধ্যপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তাঁদের আয়-ব্যয়ের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। কারও হয়তো আয়ের অন্য উৎস থাকতে পারে। কিন্তু দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বলতে হয়, হয়তো অনেকেই অবৈধ পথে উপার্জিত টাকায় সন্তানদের বিদেশে পড়ানোর খরচ বহন করেন।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পারি, দেশে পুকুর কিংবা সাগর চুরি করে কেউ কেউ ভিনদেশে মিলিয়ন ডলারের বাড়ি করেছেন। তাঁরা সবাই কিন্তু সনদপ্রাপ্ত ব্যক্তি। কিন্তু চুরি করে বিশাল সম্পদের অধিকারী হতে তাঁদের এক বিন্দু দ্বিধা জাগেনি। আমার মতে, এ ধরনের সনদপ্রাপ্তরা সত্যিকার অর্থে শিক্ষালাভ করতে পারেননি।

একটি সম্পূর্ণ বিপরীত উদাহরণও তুলে ধরতে পারি। একবার আমি ব্যাংককের এক হোটেলের রুমে দুই হাজার ডলার রেখে এসেছিলাম। ভুল বুঝতে পেরে যখন ফেরত গেলাম, তখন হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাকে বললেন, রুম পরিষ্কার করার সময় হোটেলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ডলারগুলো পেয়ে কর্তৃপক্ষের হাতে দিয়ে গেছেন। এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কতটুকু তা আমার জানার সুযোগ হয়নি। তবে আমি নিশ্চিত যে নৈতিকতার শিক্ষা তাঁর আছে।

যে দুটি উদাহরণ দিলাম, তার মধ্যে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু সব পরিস্থিতি এমন সাদা-কালোর মতো স্পষ্ট নয়। বাস্তবে অধিকাংশ পরিস্থিতি ধূসর অঞ্চলে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে ভালো–মন্দ নির্ধারণ করা জটিল। এই জটিলতা বিশ্লেষণ করে যিনি যত বেশি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, জ্ঞানের দিক থেকে তাঁর অবস্থান তত উঁচুতে হবে। এতে তাঁরা শুধু যে মনের শান্তি পাবেন তা নয়, কর্মজীবনেও সফলতা আসবে। নীতিবান মানুষ সম্মান ঠিকই পাবেন। কারণ, হৃদয়ের খুব গভীরে মানবতারই সব সময় জয় হয়।

যাঁরা এ বিষয়ে জানতে আগ্রহী, তাঁদের জ্ঞানের পরিধি আরও বাড়াতে উৎসাহ দেব। আর যাঁরা নৈতিকতার চর্চা করতে চান, তাঁদের ছোটবেলার পাঠ্যবইতে পড়া খুব সহজ দুটি কথা মনে রাখতে বলব:

১. সদা সত্য কথা বলব।

২. সৎ পথে চলব।

এ দুটি শিক্ষা যদি মনে–প্রাণে গ্রহণ করেন, নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে যদি এর প্রতিফলন ঘটান, তাহলেই সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার যাত্রায় অনেকটা এগিয়ে যাবেন।

যাঁরা মৌলিক নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য নিচে কয়েকটা ওয়েব ঠিকানা দিলাম।

১. মোরালিটিজ অব এভরিডে লাইফ—ইয়েল: coursera.org/learn/moralities 

২. এথিক্যাল লিডারশিপ থ্রু গিভিং ভয়েস টু ভ্যালুজ—ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া: coursera.org/learn/uva-darden-giving-voice-to-values

৩. ইফেকটিভ আলট্রুয়িজম—প্রিন্সটন: coursera.org/learn/altruism

৪. হোয়াট ইজ করাপশন: অ্যান্টি করাপশন অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স—ইউনিভার্সিটি অব পেনিসিলভানিয়া: coursera.org/learn/what-is-corruption-anti-corruption-compliance 

অমিত চাকমা: অমিত চাকমার জন্ম রাঙামাটিতে, ১৯৫৯ সালে। দীর্ঘদিন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওর উপাচার্য ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনের বক্তা ছিলেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানে তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি দেওয়া হয়।

অমিত চাকমার লেখা ‘বদলের হাওয়া বইছে, তার সঙ্গে উড়তে শিখুন’ পড়ুন স্বপ্ন নিয়ের আগামী সংখ্যায়