ব্যাঙটা খেয়েই ফেলুন!

‘কীভাবে সময় কাটছে?’ করোনাকালের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ছুটিতে বারবার ঘুরেফিরে আসছে এই প্রশ্ন। বই পড়ছি, সিনেমা দেখছি, রান্না করছি, অনলাইন কোর্স করছি—এমন দারুণ কিছু উত্তর যেমন আসছে, তেমনি মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে। অনেকেই বলছেন ‘ভাবছি বইটা পড়ব, কিন্তু কেন যেন ঠিক হয়ে উঠছে না’, ‘কোর্সটা আজ শুরু করব ভেবেছিলাম, থাক কাল করব’। এই ‘করব করব ভাবছি কিন্তু করছি না’ প্রবণতাকে ইংরেজিতে বলে ‘প্রোকাস্টিনেশন,’ বাংলায় গড়িমসি। ২০১৭ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, গত ৩০ বছরে বিশ্বব্যাপী ‘প্রোকাস্টিনেশন’ অন্তত চার গুণ বেড়েছে। অথচ হাতে থাকা ব্যাঙটি খেয়ে ফেললেই কিন্তু ‘জমে থাকা কাজের পাহাড়’–এর বোঝা হালকা হয়ে যাবে।

অদ্ভুত এই পরামর্শ দিয়েছেন কানাডীয়-মার্কিন লেখক ব্রায়ান ট্রেসি। ইট দ্য ফ্রগ: টোয়েন্টি ওয়ান ওয়েইজ টু স্টপ প্রোকাস্টিনেটিং অ্যান্ড গেট মোর ডান ইন লেস টাইম নামের বইটির শুরুতেই ট্রেসি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তোমার ব্যাঙটিই তোমার জন্য সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে জরুরি। যদি তোমার কাছে দুটি ব্যাঙ থাকে, প্রথমে “কুৎসিত” ব্যাঙটা খাও। যদি তোমাকে একটি ব্যাঙ খেতেই হয়, তবে যত জলদি পারো সেটি খেয়ে ফেলো।’

গড়িমসির মধ্যে ব্যাঙ কোথা থেকে এল, ভেবে ভেবে মাথা ‘হ্যাং’ করে ফেলবেন না। একটি গল্প থেকে সহজেই খোলাসা হবে ব্রায়ান ট্রেসির বইয়ের নামকরণের রহস্য। প্রখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন একবার বললেন, ‘যদি প্রতিদিন একটা করে জীবন্ত ব্যাঙ খেয়ে তোমার দিন শুরু করতে হয়, তবে বাকি দিনটা কিন্তু তুমি ভীষণ স্বস্তিতে কাটাবে। কারণ সারা দিন যা-ই হোক না কেন, নিশ্চয় ব্যাঙ খাওয়ার চেয়ে খারাপ কিছু হবে না।’

ব্যস, ট্রেসি এই গল্পের ব্যাঙকেই ধরে নিলেন ‘জমে থাকা কাজ’–এর রূপক হিসেবে। আপনি যদি দিনের শুরুতেই সবচেয়ে কঠিন কাজটা করে ফেলেন, বাকি দিনটা বেশ আনন্দময় হবে। আর ব্যাঙ যেহেতু খেতেই হবে, জমিয়ে রেখে লাভ কী! সবচেয়ে কুৎসিত ব্যাঙ, অর্থাৎ সবচেয়ে কঠিন কাজটা দিয়েই নাহয় দিন শুরু হোক। কঠিন কাজটা সেরে ফেলেছেন, এই স্বস্তিই আপনার বাকি দিনটা সুন্দর করে দেবে।

গত ৩০ বছরে ১০৭টি দেশে বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের ব্যক্তিগত ও পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর কাজ করেছেন ব্রায়ান ট্রেসি। অভিজ্ঞতা ও গবেষণার আলোকে লিখেছেন ৭০টির বেশি বই। ২০০১ সালে ‘সসীম সময় কিন্তু অসীম কাজ’–এর চিরায়ত ধাঁধার ২১টি সমাধান নিয়ে লিখেছেন ইট দ্য ফ্রগ। তবে অতিরঞ্জিত কোনো তত্ত্ব বা অসম্ভব কোনো সাফল্যের কথা সেখানে বলেননি ট্রেসি। বরং নির্দ্বিধায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন বাস্তবতা, ‘সময় ব্যবস্থাপনার দুর্দান্ত কোনো উপায় অবলম্বন করে সব কাজ শেষ করে ফেলতে পারবেন, এ ধারণা পুরোপুরি ভুল। যত বেশি কাজই করেন না কেন, দেখবেন সামনে আরও অনেক কাজ। আর যত বেশি সময়ই আপনার হাতে থাকুক না কেন, তা কখনোই যথেষ্ট নয়।’ তবে জীবনোপযোগী কিছু দুর্দান্ত পরামর্শ পাওয়া যায় ব্রায়ান টেরির বইতে। কয়েকটি পরামর্শ তুলে ধরি, হয়তো তা আপনাকে উদ্যমী হতে সাহায্য করবে।

১. মেনে চলতে পারেন এবিসিডিই মেথড। জমে থাকা কাজগুলো ঝটপট লিখে ফেলুন। সবচেয়ে জরুরি কাজগুলোর পাশে লেখা থাকবে ‘এ’, যেটি তার চেয়ে একটু কম জরুরি, তার পাশে লেখা থাকবে ‘বি’। এভাবে কাজের গুরুত্ব অনুসারে সব কাজকে ‘এ বি সি ডি ই’ দিয়ে চিহ্নিত করুন। মনে রাখবেন, প্রথমে হাতে তুলে নিতে হবে সবচেয়ে জরুরি কাজটি। ব্রায়ান ট্রেসি বলছেন, কাজের তুলনামূলক গুরুত্ব বিচারের ক্ষমতা অনেকাংশেই আপনার সাফল্য নির্ধারণ করে।

২. বাড়াতে হবে দক্ষতা। যেমন, আপনি যদি মিনিটে ২০টি শব্দ লিখতে পারেন, তবে হয়তো আপনার অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতে তিন ঘণ্টা লাগে। কিন্তু যদি আপনার লেখা মানে টাইপ করার গতি বাড়াতে পারেন এবং মিনিটে ৬০ শব্দ লিখতে শুরু করেন, তবে ঘণ্টা দুয়েকেই অ্যাসাইনমেন্টটি শেষ করে ফেলতে পারবেন।

৩. মোবাইল, ওয়েব ব্রাউজার, ফেসবুক ইত্যাদি ‘প্রযুক্তিগত সময়ক্ষেপণ’ থেকে নিজেকে রক্ষা করুন। ট্রেসির মতে, কাজের মধ্যে প্রায়ই আমরা একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস, দুইটা নোটিফিকেশন, তিনটা টেক্সট মেসেজের চক্রে পড়ে যাই। আর হারিয়ে ফেলি কাজের প্রতি একাগ্রতা ও মনোযোগ।

৪. ভীষণ জটিল ও বিশাল কোনো কাজ সামনে পড়লেই তা আগামীর জন্য ফেলে রাখবেন না। বরং কাজটিকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে ফেলুন, এরপর একটি করে অংশ শেষ করতে থাকুন। বড় কাজগুলোকে এমন ছোট ছোট অংশে ভাগ করে এগোনোর উপায়কে ট্রেসি বলেছেন, ‘স্লাইস অ্যান্ড ডাইস’ পদ্ধতি।

৫. ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখার চর্চা করুন। ব্যর্থতা থেকেও শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করুন, যেন ভবিষ্যতে ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি না হয়।