নীরব ক্যাম্পাস, সরব ক্লাব

>শিক্ষার্থীদের সংগঠনগুলোই তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের প্রাণ। করোনাভাইরাসের কারণে ক্যাম্পাস এখন প্রাণহীন, তাই বলে ক্লাবগুলো থেমে নেই। ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় নানা আয়োজনে সক্রিয়, সরব আছে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বেশ কিছু সংগঠন। কয়েকটি সংগঠনের সাম্প্রতিক কার্যক্রম নিয়ে লিখেছেন জাওয়াদুল আলম
বিজ্ঞাপন নির্মাণ বিষয়ে কর্মশালা আয়োজন করা হয়েছে অনলাইনে
বিজ্ঞাপন নির্মাণ বিষয়ে কর্মশালা আয়োজন করা হয়েছে অনলাইনে

বিইউপি বিজনেস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ক্লাব

হঠাৎই ছুটির কবলে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন বন্ধ হয়ে গেল, তখন থেকেই অনলাইন মাধ্যম কাজে লাগাতে শুরু করে ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) বিজনেস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ক্লাব। গত এপ্রিলে তারা ‘বিজ কোয়েস্ট’ শীর্ষক একটি অনলাইন সেমিনার আয়োজন করে। তিন দিনের এই সেমিনারে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীরা। শুধু বিজনেস কম্পিটিশন আর বিজনেস কেস সলভিং বিষয়ে আলোচনা ছাড়াও সেমিনারের একটি মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। নিবন্ধন ফি থেকে সংগৃহীত ৩৫ হাজার টাকা দেওয়া হয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের তহবিলে।

এরপর নিয়মিতভাবে বাংলালিংক, বিকাশ এবং ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর মতো দেশীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে বেশ কয়েকটি দক্ষতা উন্নয়ন সেমিনারের আয়োজন করেছে ক্লাবটি। আজ ৫ জুলাই থেকে ক্লাবের আয়োজনে শুরু হচ্ছে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞাপন নির্মাণ প্রতিযোগিতা—‘ইন্ট্রা বিইউপি ক্রিঅ্যাডিভ’। বিইউপির বিভিন্ন বিভাগের তিন শর বেশি শিক্ষার্থীর মোট ৭৯টি দল অংশ নিচ্ছে এতে। চূড়ান্ত পর্বে বিজয়ী দলটি সরাসরি অংশ নেবে ক্রিঅ্যাডিভের জাতীয় আয়োজনে। বিইউপি বিজনেস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ক্লাবই জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতাটির আয়োজক।

বিইউপি বিজনেস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট মৃত্তিকা সাদী বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে ক্রিঅ্যাডিভও আমরা খুব শিগগির অনলাইনে শুরু করতে চাই। নিজেদের প্রস্তুত করার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ছোট পরিসরে আগে প্রতিযোগিতাটির আয়োজন করেছি।’ অনলাইনে প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে গিয়ে নতুন অনেক কিছু শিখছেন বলে জানালেন বিইউপির এই শিক্ষার্থী। যেমন খাবার, ব্যানার, সাজসজ্জাসহ নানা খাতের খরচ একেবারেই কমে গেছে। তবে অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে জুম, স্ট্রিমইয়ার্ডসহ ভিডিও সভা করার বিভিন্ন মাধ্যমের গ্রাহক ফি যোগ হচ্ছে। এটাও এক নতুন অভিজ্ঞতা।

অনলাইনে আয়োজিত আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক উৎসবে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির পরিবেশনা।
অনলাইনে আয়োজিত আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক উৎসবে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির পরিবেশনা।

ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি কালচারাল ক্লাব

নাচ, গান, নাটক, নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনে বছরজুড়েই ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখে চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির কালচারাল ক্লাব। বহুদিন ধরে একটা আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা করছিল তারা। ইচ্ছে ছিল, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দর প্রাঙ্গণে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংস্কৃতিক সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। সে সুযোগ হয়নি। তাই দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মতো করে অনলাইনেই আয়োজন করা হয়েছে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক উৎসবের।

‘হারমনি অব আর্টস শিরোনামে এই উৎসব হয়েছে ৩১ মে ও ১ জুন। স্বাগতিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও উৎসবে অংশ নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম।

আয়োজক ক্লাবের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে একযোগে প্রচারিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। অংশগ্রহণকারীরা ঘরে বসেই গান, নাচ অথবা বাদ্যযন্ত্রের পরিবেশনা ভিডিও করে পাঠিয়েছেন আয়োজকদের কাছে। এদিকে ঘরে বসেই শঙ্খচিলের কোয়ারেন্টিন শিরোনামে একটি ছোট নাটক উপস্থাপন করেছে আয়োজক ক্লাবটি। অনলাইন ক্লাস আর কোয়ারেন্টিন জীবনের নানা অভিজ্ঞতা হাস্যরসের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন তাঁরা।

ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি কালচারাল ক্লাবের সহসভাপতি প্রশান্ত ভৌমিক বলেন, ‘ঘরে বসে এই ধরনের আয়োজন সত্যিই বেশ কঠিন ছিল। আবার যাঁরা অংশ নিয়েছেন তাঁরাও অনেক কষ্ট করে নানা কিছু বানিয়েছেন। তবে এত সাড়া পাব সত্যিই ভাবিনি।’ প্রশান্ত মনে করেন, ‘এই দুঃসময়ে সাংস্কৃতিক আয়োজনের সুবাদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ স্থাপনের একটা সুযোগ হলো, এটাই বড় প্রাপ্তি।’

বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে সাস্ট অ্যারেনা
বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে সাস্ট অ্যারেনা

সাস্ট সায়েন্স অ্যারেনা

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানবিষয়ক সংগঠনটি সাস্ট সায়েন্স অ্যারেনা—ক্যাম্পাসে নিয়মিত আয়োজন করে ‘সায়েন্স টক’ নামের একটি সেমিনার। দেশ-বিদেশের নামকরা শিক্ষক, গবেষকেরা সেখানে বক্তব্য দেন। জমে ওঠে আলোচনা আর প্রশ্নোত্তর পর্ব। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় ‘সায়েন্স ১০১’ নামে একটি ছয় পর্বের ওয়েবিনার চালু করেছিল সংগঠন। গত ২২ জুন বিজ্ঞানবিষয়ক এই ওয়েবিনারের শেষ পর্ব প্রচারিত হয়েছে। আয়োজকেরা জানালেন, শিগগিরই ‘অ্যাডভান্স সায়েন্স ২০১’ নামে আরেকটি ওয়েবিনার সিরিজ শুরুর প্রস্তুতি চলছে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় ছাড়াও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে সংগঠনটি। করোনার এই সময়েও সেই কার্যক্রম থেমে নেই। স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য জুন মাসে শুরু হয়েছে ‘গেম অব ব্রেনস সিজন ২’ নামের একটি বিজ্ঞানবিষয়ক সমস্যা সমাধানের প্রতিযোগিতা, ফেসবুকের মাধ্যমে যেখানে অংশ নিয়েছেন প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে প্রতিযোগিতার প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে।

১০ জুলাই থেকে ক্লাবটি শুরু করতে যাচ্ছে পাঁচ সপ্তাহের ‘ভার্চ্যুয়াল ইন্টার্নশিপ’। অনলাইননির্ভর এই শিক্ষানবিশির বিষয় হলো বিজ্ঞানভিত্তিক প্রবন্ধ লেখা ও প্রকাশ করা। মূলত গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্যই এই ইন্টার্নশিপের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানালেন সাস্ট সায়েন্স অ্যারেনার সভাপতি রাকিব হোসেন। তিনি বলেন, ‘যেসব শিক্ষার্থী গবেষণাক্ষেত্রে পেশা গড়তে চায় অথবা গবেষণাপত্র লেখার ব্যাপারে জানতে আগ্রহী, এ আয়োজন তাঁদের কাজে লাগবে। পুরো আয়োজনের নির্দেশনা দেবেন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ডসহ বাংলাদেশের অভিজ্ঞ শিক্ষক ও গবেষকেরা।’

রাকিব হোসেন মনে করেন, বর্তমানে অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রম হওয়ায় তাঁরা খুব সহজেই বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের একটি সেশন নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারছেন। ক্যাম্পাসে সশরীরে এসব অনুষ্ঠান করতে গেলে বিদেশে অবস্থানরত শিক্ষকদের দেশে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। তা ছাড়া একসঙ্গে এতজনের সময় মেলানো হয়তো সম্ভব হতো না। এ সুযোগটা কাজে লাগাতে চেষ্টা করছেন তাঁরা।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিশেষ পরিবহন সেবার ব্যবস্থা করেছে মেডিসিন ক্লাব
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিশেষ পরিবহন সেবার ব্যবস্থা করেছে মেডিসিন ক্লাব

মেডিসিন ক্লাব

দেশের মেডিকেল কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘মেডিসিন ক্লাব’। বর্তমানে দেশের ৩৫টি মেডিকেল কলেজে কার্যক্রম রয়েছে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, পাহাড়ধসসহ বিভিন্ন দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তারা। করোনা মহামারিতে অনলাইন ও সরাসরি—দুই ভাবেই কাজ করে যাচ্ছেন সংগঠনের সদস্যরা। মার্চে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার পরপরই সারা দেশে টেলিমেডিসিন সেবা চালু করে সংগঠনটি। যেন ছোটখাটো রোগে ডাক্তার দেখানোর জন্য মানুষকে বাড়ির বাইরে যেতে না হয়।

সংগঠনের ফেসবুক পেজ থেকে সপ্তাহজুড়েই আয়োজিত হয় তিনটি সরাসরি অনুষ্ঠানে। কোনো অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা কথা বলেন, কোথাও তুলে ধরা হয় সংগঠনের ইতিহাস ও কার্যক্রম, আবার একটি অনুষ্ঠানে করোনাকালীন অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন সম্মুখযোদ্ধারা।

করোনা রোগীদের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপির চাহিদা বাড়ছে। সহজের মানুষের কাছে প্লাজমা পৌঁছে দিতে মেডিসিন ক্লাব অনলাইনে চালু করেছে প্লাজমা ব্যাংক। যার ফলে ফোন করেই অনেকে পেয়ে যাচ্ছেন প্লাজমা ডোনারের সন্ধান।

মেডিসিন ক্লাবের কেন্দ্রীয় সভাপতি আরমান হোসেন বললেন, ‘আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও অ্যালামনাইরা এসব কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করছেন বলেই কাজগুলো করতে পারছি। ক্লাবের সদস্যরাও ঘরে বসেই কাজ করে যাচ্ছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্লাজমা সংগ্রহের জন্য আমাদের প্রায় ১০০ জন্য সদস্য নিয়মিত কাজ করছেন।’

এখন পর্যন্ত সংগঠনটি ৬৬ ব্যাগ প্লাজমা সরবরাহ করেছে। এমনকি সাক্ষাৎকারের জন্য মুঠোফোনে আরমানকেও পেতেও বেশ অপেক্ষা করতে হলো, কারণ রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) একজন করোনায় আক্রান্ত রোগীর জন্য ও পজিটিভ প্লাজমা সংগ্রহ করতে ছুটছিলেন তিনি। অনলাইনে স্বাস্থ্যকর্মীদের যাতায়াতের জন্য ঢাকার তিনটি রুটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য মাস্ক, পিপিই, গ্লাভস, স্যানিটাইজার বিতরণ, আম্পানদুর্গত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণও করেছে সংগঠনটি।