আমার কল্পনা যেভাবে বাস্তব হলো

খুদে এই লাইব্রেরি নিজ হাতে তৈরি করেছে উসামা
খুদে এই লাইব্রেরি নিজ হাতে তৈরি করেছে উসামা

তখন আর মাত্র ছয় দিন বাকি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, যার ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে আমার ভবিষ্যতের স্বপ্নের পথ চলা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে ঠিক তখন আমাদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেল। এরপর থেকে প্রায় তিন মাস ধরে ঘরে বন্দী, সবকিছু মিলিয়ে কেমন একটা অনিশ্চয়তায় দিন কাটানো। অনিশ্চয়তা মানুষের মনে খুব বড় একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হলো।

পড়ালেখায় একটা ঢিলেঢালা ভাব চলে এল। মনে হতে থাকল আমি বুঝি সব ভুলে যাচ্ছি। কী হবে সামনের দিনগুলোতে? একটা হতাশা পেয়ে বসছিল। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, এভাবে তো থাকা যায় না। পড়ালেখা ছাড়াও কিছু একটা করতে হবে নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য।

গল্পের বই সব সময় পড়ি। প্রতিটা বই আমার কাছে একেকটা পৃথিবী। আমার কল্পনার রাজ্যে আমি এই অন্য পৃথিবীর একেকটা চরিত্র হয়ে ঘুরে বেড়াই। কখনো জাদুর জগতের হ্যারি পটার, কখনো ড্যান ব্রাউনের রবার্ট ল্যাংডন আবার কখনোবা তিন গোয়েন্দার কিশোর পাশা মনে হয় নিজেকে। বই থেকে বইয়ে ঘুরতে ঘুরতে নিজের একটা কল্পনার জগৎ তৈরি হয়ে গেছে। সেই জগতের ক্ষুদ্র একটা অংশ হচ্ছে একটা লাইব্রেরি। তার নাম ‘ইউটোপিয়া’। বাংলায় বলে কল্পরাজ্য। আমার কল্পরাজ্যে আছে সব ধরনের বই।

মিনিয়েচারের (খুদে সংস্করণ) প্রতি আগ্রহ আমার অনেক দিনের৷ প্রথমে ছোট্ট একটা মিনিয়েচার বই বানালাম। ভাবলাম, বাহ্ বেশ মজার তো! এ রকম অনেক বই নিয়ে যদি ছোট্ট একটা লাইব্রেরি হয়, ঠিক আমার কল্পনার ইউটোপিয়ার মতো, তাহলে মন্দ কী!

কত্ত ছোট বই!
কত্ত ছোট বই!

স্কুল-কলেজে টুকটাক কিছু বিজ্ঞান প্রকল্প তৈরি করেছি। তার অবশিষ্ট বেশ কিছু যন্ত্রপাতি বাসায় ছিল। আর বাকি কিছু জিনিস জোগাড় করতে আব্বু খুব সাহায্য করল। তা নিয়েই আমার সেই কল্পরাজ্যকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজটা শুরু করলাম। একেক দিন যায়, আর ধীরে ধীরে কল্পনায় দেখা কল্পরাজ্যের একেকটা অংশ আমার চোখের সামনে বাস্তব হয়ে ওঠে। এ যে কী আনন্দ, তা বলে বোঝানো সম্ভব না। ছোট্ট ছোট্ট বই, চেয়ার, টেবিল, চশমা, বুকশেলফ তৈরি করতে করতে টানা দুই সপ্তাহ লেগে গেল। কাজ করার সময় পরীক্ষা নিয়ে এত দিন যেসব দুশ্চিন্তা কাজ করছিল, সব ভুলে গেলাম। আর সেটা আমার পড়ালেখাতে মন বসাতেও দারুণভাবে সাহায্য করল।

পুরো কাজটা যখন শেষ হলো, আমি নিজেই অবাক! অদ্ভুত রকম একটা মানসিক প্রশান্তি পেলাম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থেকে আমি সব সময় দূরে থাকতে চেষ্টা করেছি। এক মাসের কম সময় হলো একটা অ্যাকাউন্ট খুলেছি ফেসবুকে, যা দিয়ে আমি শুধু অনলাইনে ক্লাসগুলো করতাম। আমার ‘ইউটোপিয়া’ বানানো শেষ হলে ঝোঁকের বশে তার একটা ছবি ফেসবুকে দিই। আর একটা পেজ খুলে ফেলি ‘মিনিয়েচার অব ইমাজিনেশন’ নামে। কিন্তু আমি যে এত সাড়া পাব, ভাবিনি। দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করল, অভিনন্দন জানাল।

আমি জানি, আমার মতো বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এখন খুব খারাপ একটা সময় পার করছে। ঘর থেকে বেরোনো মানা। নানা দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা। তাই বলে আমাদের কল্পনা, সৃজনশীলতা তো লকডাউনে নেই। যে যার কল্পরাজ্য আমরা কিন্তু ঘরে বসেই তৈরি করতে পারি। হয়তো মিনিয়েচার নয়, হয়তো অন্য কিছু। চেষ্টা করতে দোষ কী!

আব্দুল্লাহ্ আল উসামা, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ