সফলতার আকাঙ্ক্ষা, মনোবল ও মনোভাব

অমিত চাকমা
অমিত চাকমা
>ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার উপাচার্য অমিত চাকমার জন্ম বাংলাদেশের রাঙামাটিতে। শিক্ষা, মূল্যবোধ, ভবিষ্যতের প্রস্তুতিসহ নানা বিষয়ে তাঁর ভাবনা তিনি বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চান। তাই শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়মিত লিখছেন স্বপ্ন নিয়ের জন্য। আজ ছাপা হলো তাঁর পঞ্চম লেখা। আগের চারটি লেখা পড়তে পারেন প্রথম আলো অনলাইনে (www.prothomalo.com)

বিখ্যাত মার্কিন লেখক নেপোলিয়ন হিল বহু সফল শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের সফলতার কারণ নিয়ে গবেষণার পর বলেছেন, ‘মন যা চায় ও বিশ্বাস করে, তা সে অর্জনও করতে পারে।’
শুধু আশা আর ইচ্ছা থাকলেই সফলতা আসবে না । সফলতা অর্জনের প্রাথমিক উপাদান হচ্ছে আকাঙ্ক্ষা। একটি ছোট আগুন যেমন সামান্য তাপ তৈরি করে, স্বল্প আকাঙ্ক্ষাও তেমন অনুপাতের ফলাফল আনে। এখানে স্বল্প বলতে আকাঙ্ক্ষার পরিধির কথা বলা হচ্ছে। অসাধারণ সাফল্য অর্জনের জন্য প্রথমে প্রয়োজন উদ্দ্যম, আকাঙ্ক্ষা। এরপর অসীম আত্মবিশ্বাস। মনের গভীরে অবশ্যই অনুভব করতে হবে, সাফল্য আপনার অর্জন করতে হবেই, সেই যোগ্যতা আপনার আছে। এর জন্য যা করার তা আপনি করবেন।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র বিল গেটসের আকাঙ্ক্ষা ছিল সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করার জন্য কম্পিউটারকে উপযোগী করে তোলা। আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা আর নিজের আত্মবিশ্বাসের কারণে তিনি তাঁর ডিগ্রি শেষ না করেই অক্লান্ত পরিশ্রমে সাফল্য অর্জন করেছেন। শিক্ষার সফলতার জন্যও উদ্যম, আকাঙ্ক্ষা জরুরি। বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রধান বৈশিষ্ট্য—জ্ঞানের জন্য তাঁদের অদম্য তৃষ্ণা ও আকাঙ্ক্ষা।

আমি নিজে সব কাজের জন্য এই দুটি নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করি। জীবনের একপর্যায়ে আমার অধ্যাপনা করার প্রবল ইচ্ছা গড়ে ওঠে। যখন পিএইচডি সম্পন্ন করি, তখন কানাডায় আমার বিষয় রাসায়নিক প্রকৌশলে অধ্যাপনার কোনো চাকরির সুযোগ ছিল না। তেল ও গ্যাস শিল্পে অনেক বেশি বেতনের চাকরি না করে আমি স্বল্প আয়ের ‘পোস্ট ডক্টোরাল ফেলোশিপ’ বৃত্তি নিয়ে দুই বছর অপেক্ষা করেছিলাম।

যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার প্রথম সুযোগ এল, তখন আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি খুব ভালো শিক্ষক হতে। যেহেতু ইংরেজি আমার মাতৃভাষা নয়, আর যাঁদের মাতৃভাষা ইংরেজি, তাঁদের মতো অনর্গল বলতেও পারতাম না। তা ছাড়া সাংস্কৃতিক কারণে শিক্ষার্থীদের কার্যকরভাবে শেখাতে পারার দক্ষতা সম্পর্কেও আমার কিছুটা সন্দেহ ছিল। প্রথম কোর্স পড়াতে গিয়ে সেই সন্দেহ বাস্তবে রূপ নিল। পড়ানোর সময়ই বুঝতে পারছিলাম, পড়ানোটা খুব ভালো হচ্ছে না। কানাডাতে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্সের শেষে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের মূল্যায়ন করে। আমার মূল্যায়নের ফল ভালো ছিল না। তাতে আমি হতাশ না হলেও অধ্যাপনা ছেড়ে দেওয়ার কথা গভীরভাবে ভেবেছিলাম এই কারণে যে যদি ভালো পড়াতে না পারি, তাহলে আমি অন্য কিছু করব, যেখানে আমি ভালো করতে পারব। আমার বিভাগীয় প্রধানের অনুপ্রেরণা পেয়ে পদত্যাগ না করে, দ্বিতীয়বার কোর্সটা পড়ানোর প্রস্তুতি নিই। এবার আমার প্রচেষ্টা সফল হয় এবং আমি শিক্ষাঙ্গনে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের সময়ও আমি ঠিক একইভাবে ভালো করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজ করেছি। আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল উঁচুমানের অধ্যাপক হওয়া—অদম্য প্রচেষ্টায় আমি সফল হয়েছি।

তৃতীয় যে গুণটির কথা বলব, তা হলো মনোভাব। একটি ব্যাক্তিগত উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করি। অধ্যাপনা, প্রশাসনিক কাজ ও নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করার সুযোগকে আমি কখনো জীবিকা উপার্জনের উৎস হিসেবে দেখিনি। আমি পেশাদারী প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করতে পারতাম, কিন্তু তা না করে আমি অধ্যাপনা বেছে নিয়েছি। অধ্যাপনাকে আমি একটি মহৎ কর্তব্য হিসেবে দেখে এসেছি। তরুণ শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করে তোলা আর দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো মহতী কাজ খুব কমই আছে বলে আমার ধারণা।

প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের উন্নতির জন্য আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারি, কর্তৃপক্ষ সেই আস্থা রেখেছেন। অনেক যোগ্য লোকের মধ্য থেকে আমাকে বেছে নিয়েই তো গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই আমার ব্যাক্তিগত আকাঙ্ক্ষা ও দৃঢ় সংকল্প হলো, আমি সবার চেয়ে ভালো কাজ করব। কাজ আর ব্যাক্তিগত সাফল্যকে আমি আলাদা করে দেখি না। তাই আমার কাজের কোনো সময়সীমা নাই। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে প্রয়োজনে সপ্তাহে ৭ দিন, ২৪ ঘণ্টা কাজ করতেও অসুবিধা হয় না।

মার্কিন প্রতিষ্ঠান, এভিস কার রেন্টাল কোম্পানির মোটো হলো, ‘উই ট্রাই হার্ডা’। এই আদর্শ আমার খুব পছন্দ। এরই সুর ধরে আপনি যদি ‘আরও বেশি চেষ্টা, আরও বুদ্ধিদীপ্ত কাজ’কে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন, আপনাকে কে ঠেকিয়ে রাখবে?

ইতিবাচক মনোভাব আপনার সাফল্যের জন্য একটা মূল্যবান সম্পদ। নেতিবাচক মনোভাব আপনার মঙ্গলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমাদের সবারই কম-বেশি ইতিবাচক ও নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য আছে। সময়সাপেক্ষে মানসিক চর্চার মাধ্যমে ইতিবাচক মনোভাব বাড়ানো যায়। দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, ‘যখন কিছু দেখেন, আপনি ভাবেন, “কেন?” আর আমি এমন কিছুর কল্পনা করি, যা কখনো ছিলই না। আর ভাবি, “কেন নয়?”’ কানাডার প্রাক্তন গভর্নর জেনারেল, ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডেভিড জনশটন একে বলছেন, ‘দ্য স্পিরিট অব হোয়াই নট’। সারমর্ম হলো, আমরা অনেক সময় নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে বা দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি, হ্যাঁ বলার চাইতে না বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এই অভ্যস্ততাকে দমন করে ইতিবাচক চিন্তার সূচনা করার একটা উপায় হলো প্রথমেই প্রশ্ন করা, ‘কেন নয়?’ এর যদি কোনো জোরালো উত্তর না থাকে, তাহলে সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হতেই হবে। মনের এই প্রবণতার বিষয়ে সব সময় সচেতন থাকলে নেতিবাচক প্রভাব এড়ানো সম্ভব।

মনোভাব সংক্রামক। ইতিবাচক মনোভাব আমাদের মধ্যে যেমন সর্বোত্তম গুণাবলীর চর্চা বাড়ায়, তেমনি নেতিবাচক মনোভাব আমাদের মধ্যে খারাপ বৈশিষ্ট্য তৈরি করে। সচেতনভাবে আমি তাই নেতিবাচক মানুষের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি।

এবার নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন, আপনার আকাঙ্ক্ষা কী? আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে সেই পরিমাণ মনোবল সঞ্চারের যোগ্যতা অর্জন করুন। ইতিবাচক মনোভাবকে বিকশিত করে অদ্যম প্রচেষ্টা চালিয়ে যান—একসময় সব বাধা অতিক্রম করে সফলতার দ্বারে পৌঁছে যাবেন, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

অমিত চাকমা, উপাচার্য, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়

● ‘পরিশ্রম ও শ্রমের মর্যাদা বিষয়ে অমিত চাকমার লেখা পড়ুন আগামী সংখ্যায়’