ইতিহাসে লেখা থাকবে, তোমরা 'কোভিড-১৯ জয়ী' প্রজন্ম

কন্ডোলিজা রাইস। ছবি: সংগৃহীত
কন্ডোলিজা রাইস। ছবি: সংগৃহীত
>যুক্তরাষ্ট্রের ৬৬তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন কন্ডোলিজা রাইস। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্বস সাময়িকী প্রকাশিত বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় শীর্ষে ছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে মন্ত্রিত্বের মেয়াদ শেষ হলে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন শিক্ষকতা করেই কাটছে তাঁর পুরো সময়। এ বছর সমাবর্তন পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য ইউটিউব আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল সমাবর্তন অনুষ্ঠান ‘ডিয়ার ক্লাস অব ২০২০’–এ বক্তৃতা দেন রাইস। বক্তব্যটি ‘ইউটিউব অরিজিনালস’ চ্যানেলে তোলা হয়েছে গত ৮ জুন।

সমাবর্তন পাওয়া সবাইকে অভিনন্দন। শিক্ষার্থীরা যখন তাদের পরিশ্রমের স্বীকৃতি পায়, একজন অধ্যাপক হিসেবে তা আমাকে ভীষণ আনন্দ দেয়। কেউ একবার বলেছিলেন, সমাবর্তনের মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘোষণার বিষয়টি খুব হাস্যকর। আদতে এখানে কোনো শেষ নেই। জীবনের এই পর্যায়টা হলো একই সঙ্গে একটি অধ্যায়ের শেষ ও আরেকটির শুরু।

নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে চাইলে সামনের সুন্দর দিনগুলোর দিকে তাকাও, সম্ভাবনার দিকে তাকাও। অনেক বছর পর যখন তুমি পেছন ফিরে দেখবে, তখন যেন মনে না হয় তুমি কোনো সুযোগ ফেলে এসেছ। এখন থেকেই নিজেকে এমনভাবে তৈরি করো। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, হাতে থাকা সময়গুলো চোখের নিমেষে চলে যাবে। আমার যেমন মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা, যখন আমি তোমাদের জায়গায় ছিলাম। মনে হয়, খুব বেশি দিন হয়নি যখন আমিও নিজের সমাবর্তনে বসে অতিথিদের লম্বা বক্তৃতা শেষ হওয়ার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। বিশ্বাস করো, আমি আসলে অনেক অনেক বছর আগের কথা বলছি। কিন্তু মনে হয়, এই তো সেদিন।

আমাকে কথা দাও, সামনের প্রতিটা মুহূর্ত তোমরা উপলব্ধি করবে, নিজের সেরাটা দিয়ে কাজে লাগাবে। প্রতিবন্ধকতাকে সাদরে গ্রহণ করবে, বিনয়ী হবে, নিজের মেধাকে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাবে। এখন তোমাদের বলব, কীভাবে তোমরা এসব করবে।

প্রথমত, অন্তত কোনো একটা বিষয়ের প্রতি তোমার গভীর আগ্রহ (প্যাশন) থাকতে হবে। ভেবে দেখো তো, কোন কাজটা করতে গেলে বা কোন বিষয়ে ভাবতে গেলে অনেক বেশি রোমাঞ্চিত আর উজ্জীবিত হও? যদি এখনো এমন কিছু তোমার জীবনে না থেকে থাকে, তাহলে খোঁজ চালিয়ে যাও। ছেলেবেলায় আমার স্বপ্ন ছিল পিয়ানিস্ট (পিয়ানোবাদক) হবো। পড়তে শেখার আগে আমি গাইতে শিখেছিলাম। কিন্তু কলেজে ওঠার পর উপলব্ধি করলাম, আমি গানে ভালো ছিলাম, কিন্তু সেরা ছিলাম না। এই উপলব্ধি আমার স্বপ্নকে ভেঙে দিল। আমি আবার আমার প্যাশন, আমার লক্ষ্যের খোঁজ শুরু করলাম। এরপর একদিন কলেজে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে এক রুশ বিশেষজ্ঞের ক্লাস করলাম। ঠিক সেদিন আমি বুঝতে পারলাম, জীবনে কোন দিকে যেতে চাই। মূলত তখন থেকেই শুরু হলো নতুন এক যাত্রা, যা আমাকে হোয়াইট হাউস পর্যন্ত নিয়ে গেল।

প্যাশনের সবচেয়ে মজার দিক হলো, সেটা একেবারেই তোমার নিজস্ব। আমি বড় হয়েছি অ্যালাবামার জিম ক্রোতে। সেখানে গায়ের রঙের কারণে আমার পরিবার এলাকার বাকি শ্বেতাঙ্গ পরিবারের সঙ্গে একই সিনেমা হলে বা রেস্তোরাঁয় যেতে পারত না। কিন্তু এসবের পরও আমার শিক্ষক মা-বাবা আমাকে কোনো দিন সীমিত সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে আপস করে চলতে শেখাননি। অ্যালাবামার ছোট্ট একটা শহরের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এক কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ের জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর বিশেষজ্ঞ হওয়ার স্বপ্ন দেখা ছিল বেশ অসাধ্য একটা ব্যাপার। তাই আমার অভিজ্ঞতা থেকে তোমাদের আজ একটা অনুরোধ করতে চাই, গায়ের রং, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে তুমি কী করতে পারবে আর কী পারবে না, কাউকে সেটা নির্ধারণ করতে দিয়ো না। তোমার প্যাশন, তোমার লক্ষ্য তুমি নিজে ঠিক করো।

আমি জানি, বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজের স্বপ্নকে অনুসরণ করা বেশ কঠিন। যারা এ বছর নতুন কলেজে যাবে, তোমাদের মনে নিশ্চয়ই অনেক অস্থিরতা কাজ করছে। আমরা কেউই জানি না সামাজিক দূরত্বের নতুন নিয়মে ক্যাম্পাসজীবন কেমন হবে। পড়াশোনা কতটা ক্যাম্পাসে আর কতটা অনলাইনে হবে। আদৌ কোনো ক্যাম্পাসজীবন থাকবে কি না। আর যারা এই রেকর্ড পরিমাণ ছাঁটাই আর অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়ে চাকরির বাজারে ঢুকতে যাচ্ছ, তাদের সামনে তো ভীষণ ভীতিকর ও বন্ধুর পথ। কারণ, আমরা কেউই জানি না, চাকরির বাজার আবার কবে স্বাভাবিক হবে। কবে কাটবে অর্থনৈতিক মন্দা? তবে এটুকু জানি, তোমরা সব বাধা উতরে যেতে পারবে, যেভাবে তোমরা গত কয়েকটা মাস পেরিয়ে এসেছ।

তোমার পড়াশোনার সামর্থ্য আছে, এটা তোমার সৌভাগ্য। মনে রেখো, তোমার চেয়েও মেধাবী ও যোগ্য অনেকেই আজ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সমাবর্তন নিতে পারছে না। কেউ হয়তো পারছে না পরিবারে ভাঙনের কারণে, কেউ পারছে না দারিদ্র্যের কারণে, কারও কারণ হয়তো শারীরিক অসুস্থতা। তারা অনেক স্বপ্ন দেখেও হয়তো এই সুযোগটা পেল না। প্রতিজ্ঞা করো, সুবিধাবঞ্চিত সেই মানুষগুলোর দিকে তোমরা কখনো অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখবে না, তাদের ভুলে যাবে না। বরং সুযোগ আর সামর্থ্য থাকলে তাদের সাহায্য করবে।

আমি আশা করব, নিজের সঙ্গে সঙ্গে তুমি এগিয়ে নিয়ে যাবে তোমার দেশকেও। খেয়াল রেখো, তোমার শিক্ষা যেন দেশের অবক্ষয় মুছে ফেলার কাজে লাগে। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিশাল কোনো পরিকল্পনা করতে হবে না। তুমি নিজে কোনো বিভক্তির কারণ হবে না, বিদ্বেষ ছড়াবে না—এটা দিয়েই শুরু হতে পারে দেশের এগিয়ে চলার পেছনে তোমার অবদান।

এই দুরূহ সময়েও আমি তোমাদের আশ্বস্ত করতে চাই, তোমাদের ভবিষ্যৎ আজকের চেয়েও অনেক অনেক গুণ ভালো হবে। এই মহামারি, প্রাণহানি, মন্দা তোমাদের বাস্তবতাকে যতই কঠিন করে তুলুক না কেন, ইতিহাসে তোমাদের নাম কিন্তু লেখা থাকবে ‘কোভিড-১৯ জয়ী’ প্রজন্ম হিসেবে। তাই কখনোই বর্তমান সংকটকে নিজের জীবনের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায় হিসেবে ধরে নিয়ো না। দেখবে, এই সংকট একসময় খুব ছোট মনে হবে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, তুমি কোথা থেকে উঠে এসেছ, তাতে কিছু যায় আসে না। তুমি কোথায় পৌঁছতে চাও, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা আজ তোমাদের যেই অর্জনের জন্য এত উদ্​যাপন করছি, এই শিক্ষাই হবে তোমাদের হাতিয়ার। একে সঠিকভাবে কাজে লাগাও। এরপর দেখো, কীভাবে সংকট সম্ভাবনায় বদলে যায়।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আদর রহমান