যেভাবে শ্রমের মর্যাদা দিতে শিখেছি

অমিত চাকমা
অমিত চাকমা
>ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার উপাচার্য অমিত চাকমার জন্ম বাংলাদেশের রাঙামাটিতে। শিক্ষা, মূল্যবোধ, ভবিষ্যতের প্রস্তুতিসহ নানা বিষয়ে তাঁর ভাবনা তিনি বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চান। তাই শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়মিত লিখছেন স্বপ্ন নিয়ের জন্য। আজ ছাপা হলো তাঁর ষষ্ঠ লেখা। আগের পাঁচটি লেখা পড়তে পারেন প্রথম আলো অনলাইনে (www.prothomalo.com)

যেকোনো কাজে সফল হতে হলে পরিশ্রম করতে হয়, এ কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে পরিশ্রমকে যদি কঠিন বলে মনে করা হয় এবং কেউ যদি শুধু বাধ্য হয়ে পরিশ্রমী হন, তাহলে কঠোর পরিশ্রমের পরও সাফল্য নিশ্চিত হয় না। আপনি যদি কোনো গভীর আকাঙ্ক্ষা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কঠোর পরিশ্রম করেন, তখন তা হয়ে ওঠে আনন্দদায়ক। যত বেশি কাজ করবেন, তত আনন্দ পাবেন। পরিশ্রম পরিণত হবে স্বভাবে।

শরীরচর্চাকে উদাহরণ হিসেবে দেখা যাক। যাঁরা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, শরীরচর্চা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে যায়। ব্যায়ামের পর তাঁরা ভালো বোধ করেন, না করলেই বরং খারাপ লাগে। আমি যেহেতু নিয়মিত ব্যায়ামে অভ্যস্ত নই, এটা আমার জন্য কষ্টকর। এখানে পার্থক্য হলো আমি ডাক্তারের উপদেশে বাধ্য হয়ে মাঝেমধ্যে ব্যায়াম করি আর ব্যায়ামবিদেরা করেন অভ্যাসবশত।

মানুষের জীবনে যখন হঠাৎ কোনো বিপর্যয় চলে আসে, প্রচলিত চিন্তাধারণায় বিপর্যয় থেকে মুক্তির সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন নতুন চিন্তাধারার উদয় হয়। আজকের মহামারি আমাদের অনেক কিছু নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে বাধ্য করেছে। এই মহামারির আগে বিভিন্ন পরিষেবা–সংশ্লিষ্ট কর্মী, পরিবহনশ্রমিক, কৃষিশ্রমিকদের কাজের গুরুত্ব খুব কম মানুষই বুঝত। মহামারির কারণে যখন পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ লকডাউনের আওতায় এল, তখন আমরা অনুভব করলাম যে তাঁরা কতখানি অপরিহার্য।

যখন আমরা নিজের ও অন্যের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ঘরে থাকি, তখন এই সাহসী কর্মীরা একটি ভয়ংকর ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকির মধ্যেও কাজ করছিলেন। তাঁদের অনেকে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁরা সবাই যদি আমাদের মতো বাড়ির নিরাপত্তার গণ্ডিতে থাকতেন, তাহলে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন আর সরবরাহ থেমে যেত, ওষুধের অভাব হতো, পানি-বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হতো। আমরা এক কল্পনাতীত দুর্যোগের মুখোমুখি হতাম এবং করোনাভাইরাসের কারণে যত প্রাণহানি হয়েছে, পরিণাম হতো তার চেয়ে অনেক ভয়াবহ।

সাধারণত অনেকেই একমত হন, যেকোনো শ্রমকে আমাদের শ্রদ্ধা করা উচিত। কিন্তু সবার মধ্যেই কাজের ধরন নিয়ে পক্ষপাতিত্ব আছে। কোনো কোনো কাজকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিই। এই মহামারির অভিজ্ঞতার পর মন থেকে এসব পক্ষপাতিত্ব একেবারে মুছে ফেলা উচিত।
ব্যক্তিগত কাজ ছাড়া, বেশির ভাগ কাজ করতে গেলেই দেখবেন অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। কাজ যত গুরুত্বপূর্ণ হবে, অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা তত বাড়বে। একটি জটিল প্রকল্পের সফল সমাপ্তির জন্য বিভিন্ন দক্ষতা ও পটভূমির লোকের অবদানের সমন্বয় প্রয়োজন। প্রকল্পের নেতৃত্ব যাঁর কাঁধে, সমন্বয়ের দায়িত্বও তাঁর। নেতৃত্ব তাঁরাই ভালো দিতে পারেন, যাঁরা সহকর্মীদের আস্থা ও সম্মান অর্জন করতে সক্ষম। তাই সহকর্মীদের প্রতি আপনার সহানুভূতি অবশ্যই থাকতে হবে। তাঁদের কাজ যতটুকুই হোক না কেন, তা প্রকল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাঁদের অংশগ্রহণ ছাড়া প্রকল্প সম্পন্ন হবে না। কেউ যদি ভাবেন, তাঁদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না, তাহলে কাজের মানের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে।

আমার প্রয়াত বাবার জ্ঞান সব সময় আমাকে মুগ্ধ করত। ছোটবেলা থেকে তিনি আমাকে বিভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দিতেন। যেমন বাবার উৎসাহেই আমি রাস্তার পাশে বসে আমাদের বাগানের আনারস বিক্রি করেছি, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বেবিট্যাক্সি চালিয়ে হাতখরচ উপার্জন করেছি। এ ধরনের কাজের মাধ্যমে আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই শ্রমের মর্যাদা শিখেছি। শ্রমের মর্যাদা আমার কাছে কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। শ্রমের মর্যাদার প্রতি আমার গভীর উপলব্ধি ও সম্মান রয়েছে। আমার পরবর্তী জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমি এ উপলব্ধির সুবাদে উপকৃতও হয়েছি।

আমি যখন ১৮ বছর বয়সে আরও ৯ জন বাংলাদেশি সহপাঠীর সঙ্গে আলজেরিয়ায় পড়তে যাই, অচেনা ভাষা, সংস্কৃতির কারণে নানা সমস্যায় পড়েছি। তখন গ্রীষ্মের ছুটিতে ইংল্যান্ডে গিয়ে ভারতীয় রেস্তোরাঁয় বেয়ারার কাজ খুঁজেছি, যেন আমি আলজেরিয়ায় আমার জীবনযাত্রার মান উন্নত করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করতে পারি। সমস্যা হলো এ কাজে আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তবু আমার সংকল্প ও আত্মবিশ্বাস দেখে একজন সুযোগটা দিতে রাজি হয়েছিলেন। এ সুযোগ পাওয়ার পর আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম, যেন একজন খুব ভালো একজন বেয়ারা হতে পারি। কাজের সময় নিজেকে বেয়ারা হিসেবেই দেখেছি, ছাত্র হিসেবে নয়। এ মনোভাবের জন্য খুব অল্প সময়ে আমি ভালো বেয়ারা হতে পেরেছিলাম। ফলে গ্রীষ্মের ছুটিতে কাজ পেতে আমার আর অসুবিধা হয়নি। দক্ষতা ও নিষ্ঠার কারণেই গ্রীষ্মের ছুটিতে আমি একটা নামী রেস্তোরাঁয় সর্বাধিক বেতনের বেয়ারা হিসেবে কাজ করেছি।

এ অভিজ্ঞতাকে অনেকে হয়তো তেমন গুরুত্ব দেবেন না। কিন্তু এ সাফল্য আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেবল আলজেরিয়ায় আমার চাহিদা পূরণ হয়েছে তা নয়, এ অভিজ্ঞতা থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। এমন সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করতে শিখেছি, যাঁদের শিক্ষামূলক ও সামাজিক অবস্থান আমার থেকে অনেক আলাদা ছিল। আমি তাঁদের কাজের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছি, তাঁদের প্রতি সম্মান দেখাতে শিখেছি। বুঝতে পেরেছি, তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া আমি আমার কাজটা করতে পারতাম না। আবার রান্নাঘরের শেফ যদি ভালো রান্না না করতেন, তাহলে ভালো খাবার পরিবেশন করা হতো না। সর্বোপরি, এ অভিজ্ঞতা আমার মনে যেকোনো ধরনের শ্রমের মর্যাদাকে দৃঢ় করেছে।

ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন স্তরে ১০ হাজারের বেশি কর্মী রয়েছেন। তাঁদের প্রতি আমার অনেক দায়িত্ব। বেয়ারা হিসেবে যে শিক্ষা পেয়েছি, তা থেকে আমি যে আমার অফিস সহকারীদের মূল্যায়ন যথাযথভাবে করতে পারি, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এ উপলব্ধি আমার কাজের মানও উন্নত করেছে।

সব রকম শ্রমকে শ্রদ্ধা করুন। সবার প্রতি আপনার শ্রদ্ধা ও প্রশংসা তুলে ধরতে শিখুন। দেখবেন যেকোনো কাজ আপনি আনন্দ আর উৎসাহের সঙ্গে সম্পাদন করতে পারবেন। সফলতার পথ হবে আরও সহজ।

অমিত চাকমা
উপাচার্য, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়