স্কুলের নাম দিলাম 'শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ'

হুমায়ূন আহমেদ।  ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
>আজ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০০ সালে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। কেন স্কুল তৈরির কথা ভাবলেন, কেমন স্কুলের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি, এসব প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর কচ্ছপকাহিনি শিরোনামের একটি লেখায়। ২০১১ সালের ২০ নভেম্বর প্রথম আলোতে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এটি অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত নিউইয়র্কের আকাশে ঝলমলে রোদ বইতে গ্রন্থিত হয়েছে। লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই লেখার অংশবিশেষ ছাপা হলো আজ।

প্রায় ১০০ বছর আগে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রামের দৃশ্যচিত্র। আসরের নামাজ শেষ করে মাদ্রাসার একজন হতদরিদ্র শিক্ষক তাঁর বড় দুই পুত্রকে ডেকে পাঠালেন। তাদের বললেন, ‘আমি হতদরিদ্র, নাদান একজন মানুষ। তোমাদের দুজনকে পড়াশোনা করানোর সাধ্য আমার নাই। আমি একজনকে পড়াশোনা করাব। অন্যজন গৃহস্থি (খেতের কাজ) করবে। তোমরা দুই ভাই আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসো, কে পড়াশোনা করবে, আর কে গৃহস্থি করবে। এই নিয়ে যেন পরে ভাইয়ে ভাইয়ে মনোমালিন্য না হয়। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ আল্লাহ পাক অপছন্দ করেন।’

ঘটনা শুনে বড় ভাই কাঁদতে শুরু করল। কারণ, তার খুব স্কুলে পড়ার শখ। তার ধারণা হলো, হয়তো এই সুযোগ সে পাবে না। তার ছোট ভাই বড়জনের কান্না দেখে বাবাকে বলল, ‘আমি গৃহস্থি করব। বড় ভাই পড়াশোনা করুক।’
সেই অঞ্চলে সত্তর মাইলের মধ্যে কোনো স্কুল নেই। সত্তর মাইল দূরে বাচ্চা একটা ছেলেকে জায়গির পাঠানো হলো। অন্যের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করবে। বিনিময়ে তাদের ফুট-ফরমাশ খাটবে।
গরমের ছুটিতে বালক জায়গির থেকে বাড়িতে ফিরেছে। বালকের মা বললেন, ‘বাবা গো! খাওয়াদাওয়া তারা ঠিকমতো দিত?’

বালক বলল, ‘দিত। কিন্তু তরকারিতে লবণ কম বলে খেতে পারতাম না।’
তুমি লবণ চাইতা?
আমার লজ্জা করে।

গরমের ছুটির পর বালক জায়গিরে ফিরে যাচ্ছে। বালকের মা তার সঙ্গে বাঁশের চোঙের ভেতর ভরে লবণ দিয়ে দিলেন, যাতে বালককে লবণের কষ্ট না করতে হয়।
বালকের নাম ফয়জুর রহমান আহমেদ। আমার বাবা। অতি দুর্গম গ্রামের তিনি প্রথম ম্যাট্রিকুলেট, তিনি প্রথম গ্র্যাজুয়েট।

মুসলমান একটি ছেলে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে শুনে আঠারোবাড়ীর জমিদার তাকে দেখতে চাইলেন। বাবা খালি পায়ে জমিদারের সামনে উপস্থিত হলেন। সেই সময় ছাতা মাথায় দিয়ে জুতা পরে জমিদারের সামনে যাওয়া যেত না। জমিদার বললেন, ‘বাবা, তুমি জুতা পায়ে আমার কাছে আসার যোগ্যতা অর্জন করেছ। আর কখনো আমার সামনে খালি পায়ে আসবে না।’

এই জমিদারের কথা আমি মধ্যাহ্ন উপন্যাসে উল্লেখ করেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই জমিদারের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গান, ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে’ এই জমিদার বাড়িতে লেখা।

বাঁশের চোঙায় লবণ নিয়ে জায়গির বাড়িতে যাওয়ার বিষয়টা একসময় আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। দুপুরে ভাত খাচ্ছি। তরকারিতে লবণ কম হয়েছে। পাতে লবণ নিতেই মা পুরোনো গল্প তুললেন। যেহেতু অনেকবার শোনা গল্প, আমি হুঁ হুঁ করে গেলাম। মা বললেন, তোদের গ্রামের বাড়িতে আগে যেমন স্কুল ছিল না, এখনো নেই। তুই একটা স্কুল করে দে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা কত কষ্ট করে দূরে দূরে পড়তে যায়।

আমি বললাম, মা, স্কুল-কলেজ করা কোনো লেখকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তবে আপনি চেয়েছেন, আমি স্কুল করে দেব।
মা বললেন, স্কুলটা যেন তোর বাবার নামে হয়।

আমি বললাম, স্কুল হবে স্কুলের নামে। বাবার নামে, মায়ের নামে না। আমি স্কুলের নাম দিলাম ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নামে স্কুল। বাবা একজন শহীদ। কাজেই তাঁর নামও স্কুলে যুক্ত। মা, ঠিক আছে?
কী যে ভয়াবহ এক ঝামেলা সেদিন মাথায় নিলাম, তা আমি জানি আর জানেন বেলাল বেগ।

বেলাল বেগ সম্পর্কে বলি। ঘোরের জগতে বাস করা একজন মানুষ। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেছেন। আড়বাঁশির ওস্তাদ মানুষ। আমেরিকানরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাবরেটরি স্কুল করে, তখন তিনি সেই স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হন। বিটিভিতে চমৎকার সব শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম করতেন। একটির নাম ‘কিন্তু কেন’।

বেলাল বেগের সন্ধান আমাকে দিলেন সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে বেলাল বেগের সঙ্গে ছিলেন। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে তিনিও শিক্ষক ছিলেন। বেলাল বেগের সন্ধান করার চেষ্টা করলাম। শুনলাম, তিনি স্ত্রী ও সংসারের ওপর অভিমান করে সন্দ্বীপে একা বাস করছেন। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা আমেরিকায় থাকে। তারা বেলাল বেগকে নিয়ে যেতে চায়। বেলাল বেগ নিজের দেশ ছেড়ে যাবেন না।

বেলাল বেগকে সন্দ্বীপ থেকে আনা হলো। আমি তাঁকে স্কুলের কথা বললাম। তাঁর চোখ চকচক করতে লাগল। তিনি আমাকে কিছু শর্ত দিলেন।

১. এই স্কুল আর দশটা স্কুলের মতো হলে চলবে না। এটি হতে হবে এমন এক স্কুল, যা উন্নত দেশের স্কুলের পাশে দাঁড়াবে।
২. স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার পাশাপাশি শিখবে মোরালিটি।
৩. প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর মাথায় স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিতে হবে।

আমি বললাম, আপনি আপনার মতো করুন। সব দায়িত্ব আপনার।
বেলাল বেগ ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি চলে গেলেন আমার গ্রামের বাড়ি কুতুবপুরে। গ্রামের মানুষদের আগে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্কুলের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হবে। স্কুলের জন্য একসঙ্গে অনেকখানি জায়গা প্রয়োজন। জায়গা কিনতে হবে। এই অঞ্চলে কোনো রাস্তাঘাট নেই। রাস্তাঘাট করতে হবে। ইলেকট্রিসিটি আনতে হবে।

বেলাল বেগের কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে একদিন আমার মা তাঁকে ডেকে পাঠালেন। বেলাল বেগের হাত ধরে বললেন, বাবা, একটা পর্যায়ে সবাই আমার ছেলেকে ছেড়ে চেলে যায়। তুমি তাকে ছেড়ে যেয়ো না। সে একা স্কুলটা করতে পারবে না।
বেলাল বেগ বললেন, ‘আমি কখনো আপনার ছেলেকে ছেড়ে যাব না। আপনাকে কথা দিলাম।’

বেলাল বেগ কথা রাখেননি। স্কুল নির্মাণের মাঝপথে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে গেলেন। আমি স্কুল শেষ করলাম। অপূর্ব আর্কিটেকচারাল ডিজাইনের কী সুন্দর স্কুল! ডিজাইনার ছিল আর্কিটেকচারের দ্বিতীয় বর্ষের একজন ছাত্রী—মেহের আফরোজ শাওন। (সংক্ষেপিত)