ষোলোতেই যেভাবে উদ্যোক্তা ফাহিম
>খুব অল্প বয়সে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন ফাহিম সালেহ। বাংলাদেশে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি। নাইজেরিয়া, কলম্বিয়াতেও বিভিন্ন উদ্যোগে বিনিয়োগ করেছেন। ১৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে নিজের বাসায় এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ফাহিম সালেহ। তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৩ বছর। এত অল্প বয়সে যিনি নানা উদ্যোগ নিয়েছেন, ব্যবসা সম্পর্কে তাঁর ভাবনা কী ছিল? ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর মিডিয়াম ডটকমে প্রকাশিত একটি ব্লগে উদ্যোক্তাদের জন্য চারটি পরামর্শ দিয়েছিলেন ফাহিম সালেহ।
১৬ বছর বয়সে একজন ওয়েবসাইট ডেভেলপার হিসেবে আমার যাত্রা শুরু। এটিই আমাকে নিয়ে যায় উদ্যোক্তাদের দুনিয়ায়। তখন থেকে আমি বড় বড় উদ্যোগ নিয়েছি। যেমন অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছি, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্যোক্তাদের তহবিল দেয় এবং বেড়ে উঠতে সহায়তা করে।
এই পথচলায় আমি অনেক কিছু শিখেছি। কিন্তু হাইস্কুলে পড়ার সময় আমার কৌশলগত চিন্তাধারার যে ভিত গড়ে উঠেছিল, সেটিই আমাকে পরে মিলিয়ন ডলার আয় করতে সহায়তা করেছে। আপনার বয়স হতে পারে ১৬ বা ৬১, তাতে কিছু আসে যায় না। আমি মনে করি প্রত্যেক উদ্যোক্তার চারটি কাজ করা উচিত।
১
কম গুরুত্বের কাজ বাইরে থেকে করিয়ে নেওয়া
ফ্রিল্যান্সাররা হতে পারেন আপনার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তাঁরা আপনার সময় ও টাকা, দুটোই বাঁচান, যা একজন উদ্যোক্তার জন্য মূল্যবান। ১৬ বছর বয়সে আমি এমন বেশ কয়েকটা সাইট চালাতাম, যেগুলো থেকে ব্যবহারকারীরা ছবি নামাতে পারতেন। এই সামান্য কাজ করতে গিয়ে আমার এত বেশি সময় চলে যেত যে আমি নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করার, নতুন সাইট চালু কিংবা ব্যবসাকে আরও বড় করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রমগুলো করতে পারছিলাম না। অতএব আমি ফ্রিল্যান্সিংয়ের ওয়েবসাইটগুলো ব্যবহার করতে শুরু করলাম। দেখলাম, এখানে ফ্রিল্যান্সারদের বিশাল এক দল আছে, যারা সাশ্রয়ী মূ্ল্যে ভার্চ্যুয়ালি আপনার চাহিদামতো কাজ করে দিতে পারে।
এখনকার দিনে তো মানসম্পন্ন ফ্রিল্যান্সার পাওয়া আরও সহজ। বিশাল বড় ফ্রিল্যান্সারদের বাজার গড়ে উঠেছে। আপনি আপনার চাহিদার কথা জানাবেন। যাঁরা আগ্রহী, তাঁরাও বলবেন কত টাকার বিনিময়ে তাঁরা কাজটা করতে পারবেন। আপওয়ার্ক এবং এই ধরনের অন্যান্য সাইটে (মার্কেটপ্লেস) ফ্রিল্যান্সারদের কাজের পর্যালোচনা থাকে। সেগুলো দেখে আপনি বুঝতে পারবেন যে ওই ফ্রিল্যান্সার তাঁর কাজে কতটা দক্ষ।
এটা ঠিক, আমি যেসব ফ্রিল্যান্সারদের কাজ দিতাম, তাঁদের তৈরি করতে অনেক সময় চলে যেত। দিন শেষে এটা সব সময় সার্থক হতো। ভিনদেশে বসা এক ফ্রিল্যান্সারকে ঘণ্টায় ৬ থেকে ১০ ডলার দিয়ে, তাঁদের কাজটা বোঝাতে এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে আমার যে সময় বাঁচত, সে সময়ে আমি আরও অনেক কাজ এগিয়ে রাখতে পারতাম।
২
মানুষের কাছে যান এবং সাহায্য চান
কত মানুষ যে একেবারে অচেনা একজনের দিকেও সাহায্যের হাত বাড়াতে আগ্রহী, জেনে বিস্মিত হবেন। ১৬ বছর বয়সে আমার মাথায় দারুণ একটা ওয়েবসাইটের ভাবনা এসেছিল। কিন্তু হোস্টিংয়ের টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না। বাবার কাছে টাকা চাওয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না। তাই আমি বিভিন্ন অনলাইন বিজনেস ফোরামে ঢুঁ মারতে শুরু করলাম। দেখিই না ভাগ্য পরীক্ষা করে, কী হয়!
অনেকে সোজাসাপ্টা বলে দিল, ‘তোমার জন্য শুভকামনা।’ কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে আমি ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপন বসানোর বিনিময়ে দুটি হোস্টিংয়ের প্রস্তাব পেয়ে গেলাম। অতএব বাস্তবিকভাবেই আমি আমার প্রথম ডোমেইন ও ওয়েবসাইট চালু করেছিলাম বিনা মূল্যে।
আমার পরামর্শ হলো, হোক মার্কিন গায়িকা বেয়ন্স, কোনো এক বিখ্যাত খেলোয়াড় কিংবা প্রযুক্তি দুনিয়ার কোনো একজন বড় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সাহায্যের জন্য কারও কাছে যেতে ভয় পাবেন না। হয়তো ইতিবাচক সাড়া দিয়ে তাঁরা আপনাকে অবাক করে দেবেন।
৩
সমমনা মানুষকে পাশে রাখুন
সঠিক অনুপ্রেরণা ও সহায়ককর্মী খুঁজে পাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনলাইনে ওয়েবসাইট ডেভেলপারদের যেসব ক্ষেত্র আছে, ১৬ বছর বয়সে আমি সেসব জায়গায় বিচরণ করতে শুরু করি। বিভিন্ন ফোরামে অনেকের সঙ্গে পেশাগত সম্পর্ক হলো। জানলাম, কীভাবে শুধু ওয়েবসাইট বানিয়েই মাসে ১০ হাজার ডলার আয় করা যায়।
আমি একেবারেই তরুণ ছিলাম। অনলাইনে লোকে যেহেতু আমার বয়স দেখতে পাচ্ছে না, এটা একটা সুবিধা ছিল। আমি নিশ্চিত, তাঁরা যদি জানতেন যে আমি স্রেফ একজন টিনএজার, তাঁরা আমার কথার এত গুরুত্ব দিত না।
এখন আমি মুখোমুখি বসে ব্যবসা করতে পছন্দ করি। কখনো কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হলে কিংবা রাতের খাবার খেতে খেতে সরাসরি কথা বললে দ্রুত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। চোখে চোখ রাখা কিংবা অভিব্যক্তির প্রকাশ পরস্পর বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
৪
ভাবমূর্তি গড়ার পেছনে বিনিয়োগ
লোকে কীভাবে নিচ্ছে, সেটাই সব—বিশেষ করে যখন আপনি একটা ব্যবসা দাঁড় করাবেন। বর্তমান সময়ে সাশ্রয়ী প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে একটা দুর্দান্ত ব্র্যান্ড বা ভাবমূর্তি গড়ে তোলার সক্ষমতা যে কারও আছে। এ কারণেই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের বড় ক্লায়েন্ট বা বিনিয়োগকারী পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
১৬ বছর বয়সেই আমি চেয়েছিলাম, আমার ব্যবসাটা যেন দেখতে নিখাদ হয়। তাই আমি ভিনদেশি পেশাদার ওয়েব ডিজাইনারদের কাজ দিয়েছিলাম, কারণ এই পদ্ধতিটা সাশ্রয়ী ছিল। আমাদের একটা ঝকঝকে, মানসম্মত ওয়েবসাইট ছিল, যা বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে একটা ভালো ভাবমূর্তি তৈরি করেছে। এমনকি লোকে ফোন করে আমাদের সেলস ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলতে চাইত। অথচ বাস্তবতা হলো, এই বিরাট কর্মযজ্ঞের পেছনে ছিল স্রেফ দুজন, আমি আর আমার সমবয়সী ব্যবসায়িক অংশীদার কাইল।
ব্যবসার ভাবমূর্তি গড়ে তোলার আরও হাজারো উপায় আছে। আপনি ১০ ডলারে একটা ডোমেইন (ওয়েবসাইটের ঠিকানা) কিনে অল্প কিছু ডলারের বিনিময়ে সেই ডোমেইনের জন্য একটা ই–মেইল ঠিকানাও কিনে নিতে পারেন। আর আজকাল তো স্কোয়ারেস্পেস বা উইক্সের মতো ওয়েবসাইট হোস্টিং মাধ্যম ব্যবহার করে কোনো ডেভেলপার ছাড়াই সুন্দর ওয়েবসাইট তৈরি করা যায়।
সঠিক মানসিকতা, কীভাবে কী করতে হয়, সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা এবং মৌলিক বিষয়গুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা থাকলে যে কেউ যেকোনো বয়সে একটা সফল ব্যবসা গড়ে তুলতে পারেন। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করা মোটেই অবাস্তব নয়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ