সংকট থেকেই শক্তি আসে

করোনাকালে শিক্ষার মাধ্যম, কৌশল ও উপযোগিতা পাল্টে গেছে। ছবি: খালেদ সরকার
করোনাকালে শিক্ষার মাধ্যম, কৌশল ও উপযোগিতা পাল্টে গেছে। ছবি: খালেদ সরকার

স্নাতক প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টার। অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র এসেছি। পড়ব কম্পিউটার বিজ্ঞান। ক্লাসের প্রথম দিন বুক ফুলিয়ে ক্লাস করলাম। কিন্তু কী অবাক ব্যাপার! অধ্যাপকের একটা কথাও বোধগম্য হলো না।

সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। আমি যদি না বুঝে থাকি, তাহলে নিশ্চয়ই ক্লাসের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বোঝেনি।

এরপরও একটু মিলিয়ে দেখার জন্য পাশের সহপাঠীকে জিজ্ঞেস করলাম।

সে অকপটে বলল, ‘বুঝব না কেন? এগুলো তো খুবই সহজ।’

তখনই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে গেল। ক্লাসের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই যুক্তরাষ্ট্রে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ে এসেছে। সেই সময়ে বাংলাদেশে কোনো কলেজে কম্পিউটার বিজ্ঞান তো দূরে থাক, কলেজে কোনো কম্পিউটারই ছিল না। বিশাল এক বৈষম্য।

বিমর্ষ মুখে প্রতিদিন ক্লাস করতাম। মনটা খারাপ থাকত। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা একই থাকা সত্ত্বেও পাঠ্যসূচিতে আমি ওদের সবার চেয়ে দুই বছর পিছিয়ে। কোনো কিছু বুঝতে বা করতে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হতো। সুন্দর সমতল ক্লাসরুমটি তাই আমার জন্য ছিল এক অসমতার প্রতীক।

চতুর্থ বর্ষে সিনিয়র ডিজাইন নামে নতুন এক ক্লাস নিতে হলো। ক্লাসটি চলবে এক বছর—নির্ণয় করা হবে গত তিন বছর শেখা সবকিছুর সফল প্রয়োগ ও উপযোগিতা। জানা–অজানা জ্ঞান ব্যবহার করে কাজ করা যাবে যা খুশি তাই নিয়ে। ক্লাসের এই ধরনটি যেহেতু সবার জন্য নতুন, তাই ক্লাসের চিরাচরিত অসমতল ভূমি মুহূর্তেই আমার জন্য সমতল হয়ে গেল।

অসমতল ভূমিতে চলতে অভ্যস্ত কাউকে সমতল ভূমিতে এনে দিলে কী হয় জানেন? অন্যদের তুলনায় তাঁর এগিয়ে চলার ক্ষমতা এবং গতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সে কারণেই গত তিন বছরে কম্পিউটার বিজ্ঞান ক্লাসগুলোতে টেনেটুনে পাস করা সত্ত্বেও শেষ বর্ষের ‘সিনিয়র ডিজাইন’ ক্লাসে পেয়েছিলাম সর্বোচ্চ নম্বর।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের কোচ ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ—যাঁর হাত ধরে বাংলাদেশ প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার সুযোগ করে নেয়। স্বাস্থ্য সবলতা বাড়ানোর জন্য তিনি কখনো কখনো ক্রিকেটারদের ব্যায়ামাগারের পাশাপাশি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে অনুশীলনের জন্য নিয়ে যেতেন। কারণ, অসমতল বালুতে দৌড়াতে পরিশ্রম অনেক বেশি হয়। কঠোর পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না।

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলোর একটি মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বাড়ির কাজের মধ্যে ইচ্ছা করে গোঁজামিল দিয়ে কৃত্রিমভাবে শিক্ষার্থীদের মানসিক অস্বস্তি বা সংকটে ফেলা। অনেক শিক্ষাবিদের মতে, সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে উত্তরণের অভিজ্ঞতাতেই আছে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা। যেমনটা অ্যারিস্টেটল বলে গেছেন, ‘লারনিং ক্যান নট বি ডান উইদাউট দ্য পেইন (পীড়া ছাড়া শিক্ষা সম্ভব নয়)।’

করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এখন বিশাল বৈষম্য। অনলাইনে যথাযথ শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব থেকে শুরু করে ইন্টারনেটের অপর্যাপ্ত গতি শিক্ষাব্যবস্থায় একটি অসমতা তৈরি করেছে। এটি কারও কাম্য নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে এই অসমতা দূর করতে। কিন্তু কার্যকর হতে সময় লাগবে।

জীবনের প্রতিটি প্রতিবন্ধকতা একটা সুযোগের মতো। করোনাকালে শিক্ষার মাধ্যম, কৌশল এবং উপযোগিতা পাল্টে গেছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার তারতম্য কমে এসেছে। কারণ, সবাই ক্লাস করছেন অনলাইনে। পড়াশোনার মান অনেকাংশে নির্ভর করছে শিক্ষকদের সৃজনশীলতার ওপর।

আগে অল্প সময়ে অনেক কিছু শেখানো যেত বা শেখা যেত, এখনকার অসমতল শিক্ষাব্যবস্থায় তা আর সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু অসমতল ভূমিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বিচরণ, সমস্যা সমাধানে নিরলস পরিশ্রম, স্বল্প সম্পদের সদ্ব্যবহার—শিক্ষার একটি মূল্যবান অংশ। এই পরিশ্রমের সুফল আমরা পাব করোনা–পরবর্তী সময়ে। করোনা–পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তির সুষম ব্যবহারের কিয়দংশ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়াবে।

আজ থেকে ২০ বছর পর পরবর্তী প্রজন্ম যখন আমাদেরকে প্রশ্ন করবে, ‘আচ্ছা, করোনার মহামারিতে সবকিছু যখন বন্ধ ছিল, তখন তোমরা কীভাবে জ্ঞানার্জন চালু রেখেছিলে?’

কখনো ভেবে দেখেছেন আমাদের উত্তর কী হতে পারে?

আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আমাদের এখনকার সাহসী মানসিকতা, প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অধ্যবসায়ের প্রচেষ্টা এবং মানিয়ে চলার মনন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারের কম্পিউটার বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক