হার্ভার্ডের সমাবর্তনে

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে লেখক (বাম থেকে তৃতীয়)
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে লেখক (বাম থেকে তৃতীয়)

চার বছরের পথচলা। শেষ? না, শেষের শুরু? প্রতিদিন ক্লাসে যাওয়ার দৌড়াদড়ি, নানা দেশের নানা মতের বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা। পড়াশোনা, গবেষণা, ঘুরে বেড়ানো, জানাশোনার চেষ্টায় জাদুঘর-লাইব্রেরি এখানে-সেখানে বই নিয়ে আর পড়তে হবে না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, এলিয়ট হাউসের ডাইনিং, বারান্দায় বৃষ্টি, তুষার আর রৌদ্রঝলক দেখার সমাপ্তের ঘণ্টা বেজে গেছে। হাউস মাস্টার ডাগ মেল্টনের নিয়মকানুনের কথা সব সময় মনে থাকে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬৪তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২৮ মে। বাংলাদেশের একমাত্র গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী হিসেবে এই সমাবর্তনে আমি অংশ নিই। আমি ছাড়াও পিএইচডি পর্যায়ে রেজওয়ান হক নামের আরেকজন বাংলাদেশিও অংশ নেন। ১৬ মে আমার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় সমাবর্তনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি। দেশ থেকে আমার পুরো পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে এসে হাজির। শুধু আমিই নই, সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সব শিক্ষার্থীর পরিবার-পরিজনদের মেলা বসে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের টারসেন্টেনারি থিয়েটারে শুরু হয় সমাবর্তন–যজ্ঞ। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে হার্ভার্ডের ম্যাসাচুসেটস অ্যাভিনিউ, কুইন্সি স্ট্রিট, ব্র্যাটেল স্ট্রিট, ব্রডওয়ে, কেমব্রিজ স্ট্রিটে কালো গাউন আর হ্যাট পরে ২০১৫ সালের গ্র্যাজুয়েটদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে। ক্লাস ডে স্পিকার হিসেবে এ বছর বক্তব্য দেন হলিউডের আলোচিত অভিনেত্রী নাটালি পোর্টম্যান। পোর্টম্যান হার্ভার্ড কলেজে সাইকোলজি বিষয়ে ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি সমাবর্তন বক্তব্যে বলেন, ‘১৯৯৯ সালে আমি ফ্রেশম্যান হিসেবে হার্ভার্ডে পা রাখি। এখানে আসার আগে আমি কোনো দিন ১০ পাতা লেখার চর্চা করিনি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েই আমি সপ্তাহে এক হাজার পাতা পড়ার চর্চা করতাম, আর তাতেই শেষ পর্যন্ত ৫০ পাতার থিসিস নিজে লিখেছিলাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবন ছিল দারুণ অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। আজ সব মনে পড়ছে।’ নাটালির মতোই অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার সব শিক্ষার্থীর মনে যেন গেল চার বছরের সব ঘটনার টুকরো টুকরো ফ্ল্যাশব্যাক চলছিল।
২৭ মে আয়োজন করা হয় ক্লাস ডে পিকনিক। সেদিনে বিকেলে ছিল ক্লাস ডে এক্সারসাইট। এখানে এমেস অ্যাওয়ার্ড, হার্ভার্ড ও আইভি ওরেশনস ও ক্লাস ওড হিসেবে ‘ফেয়ার হার্ভার্ড’ গাওয়া হয়। ২৮ মে সকালে ছিল মর্নিং এক্সারসাইজ। গ্র্যাজুয়েটরা ক্যাপ আর গাউন পরে ছিল ছবি তোলায় মহা ব্যস্ত। ৩২ হাজারের বেশি মানুষ হাজির ছিল এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। শিক্ষার্থী, তাদের পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব হাজির হয়েছিল এই রঙিন আয়োজনে। ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকেও এদিন দেখা গিয়েছিল হার্ভার্ড ক্যাম্পাসে। মার্ক জাকারবার্গ-পত্নী প্রিসিলার বোন মিশেলও এবারের সমাবর্তনে অংশ নেন বলে জাকারবার্গকে ক্যাম্পাসে দেখা যায়।
আমরা বন্ধুরা ছিলাম ভীষণ উত্তেজিত। সামনে নতুন জীবন, পেছনে আলোকিত স্মৃতি। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল লাৎসকি, কার্ল গাও, ভারতের রিষভ মুখার্জি, অ্যান্ড্রু লিও, অর্পন রাকসিতসহ অনেক বন্ধুর সঙ্গে ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলাম। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আমি ইবেতে ডেটা সায়েন্টিস্ট হিসেবে যোগদান করছি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আর হয়তো শিক্ষার্থী হিসেবে আসা হবে না। এখানকার শিক্ষা আর শক্তি নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রমাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্থকতা প্রমাণ করতে নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা করি।