ভালো ফল করেও চিন্তিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাইশা

বাবা মায়ের সঙ্গে মাইশা। ছবি সংগৃহীত
বাবা মায়ের সঙ্গে মাইশা। ছবি সংগৃহীত

নাজিয়া হাসান মাইশা। আগে এক চোখে দেখতে পেত। কয়েক বছর আগে সে চোখটিও নষ্ট হয়ে যায়। এরপর থেকেই পুরোপুরি অন্ধকারে ঢেকে যায় মাইশার জগৎ। তবু হারেনি মাইশা। দুই চোখে দৃষ্টি না থাকলেও সেই চোখে অনেক স্বপ্ন তাঁর।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে মাইশা এবার এস এস সি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে।
তবে এই ভালো ফল করে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে মাইশা। রাজধানীর নামকরা বা ভালো কোনো কলেজে ভর্তি হতে পারবে কি না তা নিয়ে সে চিন্তিত। তার ভাষায়, ‘ভালো কলেজগুলো তো আমাদের নিতেই চায় না।’
মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মাইশা আইসিটি বিশেষজ্ঞ হতে চায় বলে জানায়। তবে একটু পরেই বলে, ‘একেক সময় চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার হতেও তো মন চায়। কিন্তু এ বিষয়গুলো দেশে তো পড়াই সম্ভব না। তাই মনে হয় দেশের বাইরে চলে যাই।’
এবার নিয়ম অনুযায়ী কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে অনলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রে একজন ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ১৫০ টাকা আবেদন ফি টেলিটকের মাধ্যমে জমা দিয়ে সর্বোচ্চ পাঁচটি কলেজ বা সমমানের প্রতিষ্ঠানের পছন্দক্রম দিতে পারবে। অন্যদিকে খুদে বার্তার ক্ষেত্রে প্রতি কলেজ বা সমমানের প্রতিষ্ঠানের জন্য ১২০ টাকা আবেদন ফি দিয়ে পছন্দক্রম অনুযায়ী একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে পারবে।
কলেজে ভর্তির আবেদন করার পাশাপাশি মাইশা ও তার মা পছন্দক্রমে থাকা রাজধানীর দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছেন। আর কিছু প্রতিষ্ঠানে খোঁজ খবর নিয়েছেন। তবে সেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা প্রায় প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন তাঁদের প্রতিষ্ঠানে আগে কোনো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ভর্তি করেননি। এবারও সম্ভাবনা নেই।

মাইশার প্রশ্ন, ‘আচ্ছা বলেন তো, যেসব প্রতিষ্ঠান আমাকে ভর্তি করতে চাচ্ছে না, সেই সব প্রতিষ্ঠানের কি মনে হচ্ছে, তাদের আমাকে পড়াও মুখস্থ করিয়ে দিতে হবে? খালি তারা আমাকে বসার জন্য একটু জায়গা দেবে। অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে আমি তো আর বেশি কিছু চাচ্ছি না। তারপরও কেনো যে এত অনীহা! ’

এস এস সি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া মাইশা। ছবি সংগৃহীত
এস এস সি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া মাইশা। ছবি সংগৃহীত


মাইশা তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তার বাবা মঈন উদ্দিন কুয়েতে থাকেন। মাইশার মা সালমা আক্তার জানালেন, মাইশার জন্মগত গ্লুকোমা। প্রথম দিকে সে এক চোখে একটু একটু দেখতে পেত। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সে স্বাভাবিক স্কুলেই অন্যদের সঙ্গে পড়াশোনা করে। ২০০৬ সাল থেকে সে একেবারেই দেখছে না। তাই তাকে মিরপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে ভর্তি করা হয়। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত সে সেখানেই পড়াশোনা করে। তারপর ব্যাপটিস্ট মিশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে মাইশা ভর্তি হয় মিরপুর গার্লস আইডিয়ালে। এবার এ প্রতিষ্ঠান থেকে মোট সাতজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেয়। অন্যরা ‘এ’ পেয়েছে, শুধু মাইশা জিপিএ ৫ পেয়েছে।
মাইশা কথার মাঝখানে যোগ করে বলে, ‘আমি ভেবেছিলাম গোল্ডেন জিপিএ পাব। কিন্তু ভূ-গোল আর অর্থনীতিতে ‘এ’ পেয়েছি। তাই গোল্ডেন হলো না।’
মাইশা তার সংগ্রামের কথা বলে। সে বলে, ‘যারা চোখে দেখতে পায় তারা অনেক কোচিং করে। বাসায় শিক্ষকের কাছে পড়তে পারে। আমাদের বেলায় বাসায় এসেও কেউ পড়াতে চান না। নবম শ্রেণি পর্যন্ত বাসায় আমার কোনো শিক্ষকই ছিলেন না। ব্রেইলে মূল পাঠ্য বই পেতেই অনেক সমস্যা হয়। সেখানে পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য বইগুলো পড়তেই পারি না। পরীক্ষার সময় ভালো শ্রুতিলেখক পাওয়া তো আরও কষ্টকর।’
মাইশা বলে, ‘এবার ভূ-গোল পরীক্ষায় সমুদ্রের তলদেশের তিনটি চিত্র দেওয়া ছিল। চিত্র থেকে বর্ণনা করে প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। কিন্তু নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া আমার শ্রুতিলেখক চিত্রটা বুঝতেই পারেনি। ফলে আমিও উত্তর দিতে পারিনি। একই ভাবে বিভিন্ন মানচিত্র বা অন্যান্য চিত্রের মাধ্যমে যে প্রশ্নগুলো আসে তার বেশির ভাগই উত্তর করতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার হলে উপস্থিত শিক্ষকেরা একটু সাহায্য করলে আমাদের জন্য ভালো হয়। সরকারি ভাবে পরীক্ষার হলে আমাদের জন্য অতিরিক্ত ২০ মিনিট সময় বরাদ্দ থাকলেও অর্থনীতি পরীক্ষার দিন হলে যে শিক্ষক ছিলেন তিনি এ সময়ের আগেই খাতা নিয়ে নেন। পরে অবশ্য সেই শিক্ষক তাঁর এই ভুলের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু তাতে তো আর লাভ হলো না।’
এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তুমি ভালো ফলাফল করেছ-এ কথা বললে মাইশা বলে, ‘আমার আম্মু সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছেন। তিনি বই পড়ে শোনাতেন। পড়া রেকর্ড করে দেওয়া, স্কুলে আনা নেওয়া সবই করেছেন। এর বাইরে আইডিয়াল এবং ব্যাপটিস্ট মিশনের শিক্ষকদের সার্বিক সহায়তা ছাড়া ভালো ফলাফল করা কোনো ভাবেই সম্ভব হতো না।’
মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা জিনাত ফারহানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাইশা খুবই মেধাবী। ক্লাসে যারা চোখে দেখতে পায় তাদের চেয়েও সে দ্রুত পড়া বুঝতে পারত। একবার শুনলেই তা মনে রাখতে পারে। আর এখানকার শিক্ষকরাও এমন ভাবে ক্লাস নেন যাতে করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ অন্য প্রতিবন্ধীরাও পড়াটা বুঝতে পারে। সহপাঠীরাও এদের সহায়তা করে। আর সব থেকে বড় কথা, মাইশার নিজের প্রচেষ্টা তো ছিলই।’
১৮ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত জিনাত ফারহানা জানালেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান প্রায় ২৫ বছর ধরে স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও ভর্তি করছে। এখন আর কোনো অভিভাবক বা শিক্ষার্থী এ বিষয় নিয়ে আপত্তি তোলেন না। তাই যেকোনো নাম করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাইলেই এই ধরনের শিক্ষার্থীদের ভর্তি করতে পারে। তবে সে জন্য শুধু ফলাফলের সময় সেরা ১০ এর তালিকায় থাকার যে প্রতিযোগিতা তা বন্ধ করতে হবে।