বরেণ্যর স্মৃতিধন্য

ক্লাসে উপস্থিতির জন্য এই কলেজে আছে পুরস্কারের ব্যবস্থা
ক্লাসে উপস্থিতির জন্য এই কলেজে আছে পুরস্কারের ব্যবস্থা

প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর প্রশাসন ভবনে লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। দোতলায় এলইডি সাইনবোর্ডের স্ক্রলে অনবরত ভেসে যাচ্ছে কলেজের প্রয়োজনীয় তথ্য। আর আঙিনায় যেখানে যতটুকু জায়গা পাওয়া গেছে, সেখানেই ফুটে আছে ফুল। মাঠজুড়ে মিষ্টি রোদে বসে ‘গ্রুপ স্টাডিতে’ ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা। এ যেন মিলনমেলা। মুঠো মুঠো প্রাণের উচ্ছলতায় মেতে ওঠা এই আঙিনা রাজশাহী কলেজের।
এই বিদ্যাপীঠের সুনামের কারণেই অবিভক্ত ভারতবর্ষে রাজশাহী পরিচিতি ছিল। অধ্যাপক আবু হেনা তাঁর রিঅ্যাকশন অ্যান্ড রিকনসিলমেন্ট গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রাজশাহীর গর্ব করার মতো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে রাজশাহী কলেজ।’ ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে তখনকার পূর্ব বাংলায় একমাত্র রাজশাহী কলেজেই স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পাঠদান করা হতো। অবিভক্ত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও আসাম, বিহার ও ওডিশার শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজে পড়তে আসতেন।
১৮৭৩ সালে একজন মুসলিম ছাত্রসহ মোট ছয়জন ছাত্র নিয়ে শুরু হয়েছিল যাত্রা। বর্তমানে কলেজের এইচএসসিসহ ২৪টি বিভাগে স্নাতক সম্মান, স্নাতকোত্তর ও ডিগ্রি পাস কোর্সে প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থী পড়ছেন। কর্মরত শিক্ষক রয়েছেন ২৪৮ জন। ১৪ বছর উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি বন্ধ থাকার পরে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী কলেজে আবার উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। প্রথম ব্যাচে পাসের হার ছিল ৯৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। দ্বিতীয় ব্যাচের ফলাফলেই কলেজটি শিক্ষা বোর্ডে সেরা হয়। সেই সাফল্য নিয়েই এখন এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সারা দেশের মধ্যে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর আন্দোলনে কলেজটি অনন্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। শতভাগ ক্লাসে উপস্থিতির জন্য এই কলেজে রয়েছে পুরস্কারের ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদেরও ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এ কলেজের গ্রন্থাগারে রয়েছে অসংখ্য দুর্লভ-দুষ্প্রাপ্য বই, পুঁথি ও সাময়িকী। এখানে রয়েছে ভাষা আন্দোলনে জীবন উত্সর্গকারী শহীদের স্মরণে নির্মিত দেশের প্রথম শহীদ মিনার। চীনা মিস্ত্রিদের হস্তশিল্পের সমন্বয়ে ব্রিটিশ শৈলীতে কাঠের সানশেড দিয়ে নির্মিত এই কলেজের প্রশাসন ভবনটি এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাঢ় লাল বর্ণের দ্বিতল দালান যে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কলেজের আরও একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা ঐতিহাসিক মোহামেডান ফুলার হোস্টেল। খরস্রোতা পদ্মা নদীর উত্তর দিকে হজরত শাহ মখদুম (রহ.)-এর মাজার। আছে লাইব্রেরি-সমৃদ্ধ দ্বিতল মসজিদ, আধুনিক ব্যায়ামাগার, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও নয়নাভিরাম পদ্মফোটা পুকুর। এ ছাড়া বাঁধন, রোভার স্কাউট, বিতর্ক ক্লাব, সংগীতচর্চা কেন্দ্র, বরেন্দ্র থিয়েটার, অন্বেষণসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কলেজে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘ পথযাত্রায় অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তি এ কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে এফটি ডাউডিং, বিজ্ঞানী কুদরত-ই-খুদা, আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন, ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক এনামুল হক, অধ্যাপক সুনীতি কুমার ভট্টাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ইতরাত হোসেন জুবেরীসহ বেশ কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অসংখ্য কৃতী শিক্ষার্থী এ কলেজ থেকে শিক্ষা লাভ করে পরবর্তী সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিখ্যাত রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু, উপমহাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য স্যার যদুনাথ সরকার, বৈজ্ঞানিক প্রথায় ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ অন্যতম সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার মৈত্র, সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, জননেতা ও শিক্ষানুরাগী মাদার বখশ, বাংলাদেশের চার জাতীয় নেতার একজন এ এইচ এম কামারুজ্জামানের মতো বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এই কলেজের ছাত্র ছিলেন।
কয়েক দিন আগে এক সকালে কলেজের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মিঠে রোদ গায়ে মেখে মাঠজুড়ে চলছে শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট আড্ডা। একই সঙ্গে ‘গ্রুপ স্টাডি’।
কলেজের তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের উত্তর পার্শ্বে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধনের কার্যক্রম চলছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পাঁচজন রোগীর স্বজন রক্তের জন্য এসে বসে আছেন। সংগঠনের সভাপতি মাকসুদুর রহমান জানান, ‘আমরা গত বছর ২ হাজার ২৪১ ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ মঙ্গলবার কলেজের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা হয়।’
কলেজের পাঠাগারের দক্ষিণ পার্শ্বে গিয়ে দেখা যায়, রোভার স্কাউট ডেনের সামনে একদল রোভার প্যারেডে ব্যস্ত। কথা হয় ‘সিনিয়র রোভারমেট’ আরিফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজশাহী কলেজ রোভার স্কাউট গ্রুপের বার্ষিক তাঁবু বাস ও দীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তারই পূর্ব প্রস্তুতি চলছে।’
পাশেই সংগীতচর্চা কেন্দ্র থেকে ভেসে আসছিল ‘আমার সোনার দেশ আমারে বাউল বানাইলো...’। সেখানে ঢুঁ মারতেই দেখা গেল, হাতে হারমোনিয়াম নিয়ে সংগীতচর্চায় ব্যস্ত একদল শিক্ষার্থী। ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হামিদুল ইসলাম বললেন, ‘এখানে এসে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে সংগীতচর্চা করতে পারি। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করে থাকি।’
রোভার ডেনের দক্ষিণ পার্শ্বে অনুশীলন করছিলেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) ক্যাডেটরা। ক্যাডেট সার্জেন্ট মিজান বললেন, ‘দেশের যুবসমাজের নৈতিক উন্নয়ন, নেতৃত্বের বিকাশ, সামরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাতৃভূমি প্রতিরক্ষা এবং জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবী গড়ে তোলার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। এখানে দুটি পুরুষ ও একটি নারী প্লাটুন রয়েছে।’
‘সুস্থ দেহ সুস্থ মন’ স্লোগান সামনে রেখে রাজশাহী কলেজে একটি জিমনেসিয়াম রয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীরা সকালে ও বিকেলে নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীর গঠনের অনুশীলন করে থাকে।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই কলেজে রয়েছে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখানে একজন অভিজ্ঞ মেডিকেল কর্মকর্তা স্বাস্থ্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

হবিবুর রহমান
হবিবুর রহমান
এমন ক্যাম্পাস বাংলাদেশে বিরল
হবিবুর রহমান
অধ্যক্ষ, রাজশাহী কলেজ
কি একাডেমিক উন্নয়ন, কি ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, কি ক্রীড়া-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উন্নয়ন, কি শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন—প্রভৃতি উন্নয়নের জয়জয়কারের শিখরে অবস্থান করছে রাজশাহী কলেজ। নান্দনিক দৃষ্টিসম্পন্ন এমন ক্যাম্পাস বাংলাদেশে বিরল। সাংস্কৃতিক চর্চার অভয়ারণ্য রাজশাহী কলেজ ক্যাম্পাস। সরকারি বা বেসরকারি কলেজগুলোর মধ্যে ফলসহ সর্বক্ষেত্রে রাজশাহী কলেজ এ মুহূর্তে অনুকরণীয় রোল মডেল।