মন চলো চৈতালি রঙে

বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন সৌরভ। অপেক্ষা করছেন কারও জন্য। অবশেষে তাঁর সামনে এসে থামল চৈতালি। না, চৈতালি কোনো মেয়ের নাম নয়, এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন বাসের নাম! বিশ্ববিদ্যালয়ের মিরপুরবাসী শিক্ষার্থীদের আসা-যাওয়ার ভোগান্তি অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে দোতলা বাস চৈতালি। সাতসকালেই মিরপুরের পল্লবী থেকে শুরু হয় চৈতালির রুটিনমাফিক ‘আপ ট্রিপ’। পথে মিরপুর ১০, মিরপুর ১ হয়ে শ্যামলী পর্যন্ত সব কটি স্টপেজে থেমে শিক্ষার্থীদের পরিবহন করে চৈতালি। ‘ডাউন ট্রিপ’, অর্থাৎ ফেরার সময়ও ওই সব স্টপেজে দাঁড়ায়।‘ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো। বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি চৈতালি চলে যাচ্ছে। বিশাল এক দৌড় দিয়ে বাসে উঠলাম।’

সকালবেলা শুভর মতো অনেকেই এমন অ্যাকশন নায়ক বনে যান। আবার ফেরার পথেও দেখা যায় একই দৃশ্য—‘ক্লাস শেষ হতে দেরি হয়েছিল। ইতিমধ্যেই ছেড়ে দিয়েছে চৈতালি। রুদ্ধশ্বাসে ছুটে বাস ধরতে পেরেছি! নিজেদের ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।’ ইতি ও পিংকির মুখে যেন রাজ্য জয়ের হাসি। তবে আসন না পেলে রীতিমতো বাদুড়ঝোলা ঝুলতে হয়। সেও এক মহা অ্যাকশন। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ভারে ভারাক্রান্ত দুপুর ১.১৫-এর চৈতালিতে যেন ‘তিল ঠাঁই আর নাহিরে’ অবস্থা। ‘চৈতালি সব সময়ই এত টইটম্বুর থাকে যে মাঝেমধ্যে কম ভিড় দেখলে মনে হয় ভুল বাসে উঠে পড়েছি।’ বাসে দাঁড়িয়ে যেতে যেতে বলছিলেন সুমাইয়া। কিন্তু এত কষ্ট করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার চেয়ে বাইরের বাসে চেপে যাওয়াই ভালো নয় কি? ‘বাইরের বাসে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। এখানে সেই সমস্যা নেই। তাই বাস ধরতে না পারলেও চেষ্টা করি ঘণ্টা খানেক স্টপেজে দাঁড়িয়ে পরের বাসে আসার।’ সানজিদার কথায় মিলল এ প্রশ্নের জবাব।ফেসবুকের ‘চৈতালি গ্রুপ’টিও বেশ সক্রিয়। কোনো কারণে বাসের সময়সূচি পরিবর্তন করা হলে গ্রুপেই তা জানিয়ে দেওয়া হয়, যা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন চৈতালি কমিটির সদস্যরা। এ ছাড়া গ্রুপের আয়োজনে বনভোজন ও ইফতার পার্টি অনুষ্ঠিত হয়।চৈতালি সাধারণের কাছে একটি বাস, কিন্তু তাঁদের কাছে এটি একটি পরিবারের মতো, যে পরিবার শক্ত বাঁধনে বেঁধে রেখেছে তার যাত্রীদের। বলছিলেন গ্রুপের প্রেসিডেন্ট টুটুল ও সাধারণ সম্পাদক মুশফিক।

ক্লাস শেষে কার্জন হলের সামনে যখন বাস ছাড়ার অপেক্ষায় সবাই, তখন আচার মামা, ফুচকা মামা কিংবা আইসক্রিম মামার রাজত্ব চলে ফুটপাতজুড়ে। বাসের ভেতর বসেই কেউ খেতে থাকেন ঝালমুড়ি, চলে জম্পেশ আড্ডা, কেউ বা বাসে জায়গা রেখে নেমে পড়েন ফুটপাতে, মেতে ওঠেন গল্পে। একই স্টপেজ থেকে যাঁরা বাসে ওঠেন, তাঁরা একে অপরের পরিচিতজন থেকে হয়ে যান বন্ধুজন। ঝড়বৃষ্টিসিক্ত পথই হোক কিংবা তীব্র গরমে সেদ্ধ জীবনই হোক, মিরপুরের শিক্ষার্থীদের আসা-যাওয়ার নিত্যসঙ্গী এই চৈতালি। শেষবিকেলে বাসে দরজায় দাঁড়িয়ে অন্তর, চিশতী, সাফাদসহ অনেকেই গান ধরেন, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’। গানের তালে ছুটতে থাকে বাস, ছুটতে থাকে জীবন।