প্রাণের ছোঁয়া

কলেজ প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের আড্ডা। ছবি: লেখক
কলেজ প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের আড্ডা। ছবি: লেখক

মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের মূল ভবনের সামনে বিশাল মাঠ। মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার। সেই মিনারের সামনে দাঁড়িয়েই আশপাশটা দেখছিলাম। ক্রিকেট খেলছে একদল কিশোর-তরুণ, এদের মধ্যে কেউ কেউ কলেজেরই ছাত্র। একপাশে গোল হয়ে বসে আড্ডায় মেতেছেন শিক্ষার্থীরা।

শ্রাবণের দিন। রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে গত বুধবার পা রেখেছি ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাঙ্গনের ক্যাম্পাসে। কলেজের সামনের রাস্তার পাশ দিয়ে খাল বয়ে গেছে। বন্যায় পানি ঢুকে খালটা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। প্রাণের ছোঁয়া অবশ্য পুরো প্রাঙ্গণেই চোখে পড়ল। বুধ আর বৃহস্পতিবার—দুটি দিন কেটেছে এই কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। আলাপ হলো। ছবি তোলা হলো। জানা হলো ক্যাম্পাস ঘিরে তাঁদের আনন্দ-বেদনার গল্প।

বন্ধুদের আড্ডার মাঝে হঠাৎ তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি বোধহয় খানিকটা অস্বস্তি দেয়। অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারহানা আক্তার, আল-আমিন, ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষে পড়ুয়া তাহমিনা আক্তার, শাহরিয়ার আলম ও হিসাব বিজ্ঞানের আরিফুল ইসলাম অবশ্য এই প্রতিবেদককে স্বাগতই জানালেন। বললেন কলেজ নিয়ে তাঁদের গর্বের কথা। লেখাপড়া শেষে পরিবার ও সমাজের জন্য কাজ করার স্বপ্নও ব্যক্ত করলেন কেউ কেউ।

সেকাল থেকে একাল

৯৪২ সালে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল, তখন নাম ছিল মানিকগঞ্জ কলেজ। সে সময় কলেজটি জেলার ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী এলাকায় ছিল। তেরশ্রীর জমিদার শ্রী সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায় সে সময় ২০ বিঘা জমি ও ১০ হাজার টাকা দান করেন। পরের বছর কলেজটি জেলা শহরের গঙ্গাধরপট্টি এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৪৩-৪৪ সালে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর নিবাসী প্রখ্যাত দানবীর রায়বাহাদুর রণদা প্রসাদ সাহা ৬০ হাজার টাকা ও অন্যান্য আর্থিক সহায়তা দেন। সে সময় তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ সাহার নামানুসারে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের নামকরণ করা হয়।

১৯৬৩ সালে কলেজটিতে উচ্চমাধ্যমিক, পরের বছর ডিগ্রি (পাস) কোর্স চালু হয়েছে। প্রায় ২৪ একর জমির ওপর ছয়টি একাডেমিক ভবন ও একটি প্রশাসনিক ভবন রয়েছে।

বর্তমানে কলেজের কলা অনুষদে বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ইসলামি শিক্ষা, দর্শন ও ইতিহাস; বাণিজ্য অনুষদে হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, মার্কেটিং ও ফিন্যান্স এবং বিজ্ঞান অনুষদে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, গণিত, উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে স্নাতক কোর্সে পাঠদান করা হচ্ছে। এ ছাড়া ১৪টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) কোর্স চালু আছে। উচ্চমাধ্যমিক, ডিগ্রি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে এখন মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২১ হাজার ২৯৮ জন।

পাওয়ার মাঝে না পাওয়া

মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য ছাত্রাবাস আছে মাত্র দুটি, ছাত্রীনিবাস একটি। একটি দ্বিতল ভবন ও একটি টিনশেড ঘরে ১০২ জন ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। এ ছাড়া চারতলাবিশিষ্ট ছাত্রীনিবাসটিতে ১০০ জনের থাকার ব্যবস্থা হলেও সেখানে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশিসংখ্যক ছাত্রীকে।

আবাসন সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে শিক্ষকদেরও। শিক্ষকদের থাকার ব্যবস্থা নেই বলে দূরদূরান্ত থেকে এসে কলেজে ক্লাস নিতে হয়। ছাত্রছাত্রীরা জানালেন, তাঁদের ক্লাসরুম ও শিক্ষকের সংখ্যা কম। ক্যানটিনও নেই।

পাঠাগারে আছে ২২ হাজারের বেশি বই। বইয়ের খোঁজে প্রতিদিন ভিড় করেন শিক্ষার্থীরা।
পাঠাগারে আছে ২২ হাজারের বেশি বই। বইয়ের খোঁজে প্রতিদিন ভিড় করেন শিক্ষার্থীরা।

অর্জন থেমে নেই

শিক্ষকের স্বল্পতা থাকলেও ভালো লেখাপড়া ও ফলাফলের জন্য সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছে মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ। এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেল, ২ হাজার ৫২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৮১ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এ ছাড়া সর্বশেষ ২০১২ সালে শুধু হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকে ৪৬ জন ও স্নাতকোত্তরে ১০২ জন প্রথম শ্রেণি পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

প্রিয় প্রাঙ্গণ

কলেজের পেছনে রয়েছে বিশাল কাঠবাগান, বাগানের মাঝে মাঝে বসার বেঞ্চ। দুপাশে দুটি বড় পুকুর। দুপুরে দেখা গেল, গাছের ছায়ায় বেঞ্চে বসে গল্প করছেন কেউ কেউ। দেখা হলো তিন বন্ধুর সঙ্গে—স্নাতক চতুর্থ বর্ষের আতিক হাসান, শরীফুল ইসলাম ও জাহিদ হাসান। বললেন, ‘ক্লাস শেষ। পুকুরপাড়ে গাছের ছায়ায় আড্ডা কার না ভালো লাগে!’ শরীফুল জানালেন তাঁর স্বপ্নের কথা, ‘শিক্ষকতা পেশা আমার পছন্দ। বিসিএস দিয়ে কলেজে শিক্ষকতা করতে চাই।’

স্বপ্ন পূরণ করতে শরীফুলের মতো শিক্ষার্থীরা ভিড় করেন কলেজের লাইব্রেরিতে। আছে ২২ হাজারের বেশি বই। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি পত্রিকা পড়তেও এখানে পা রাখেন অনেকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাকসুদা সুলতানা লিপি বললেন, ‘সুযোগ পেলেই লাইব্রেরিতে বিভিন্ন লেখকের বই পড়তে বসে যাই। উপন্যাস ও ছোটগল্প আমার প্রিয়।’

কলেজের মাঠে নিয়মিতই চলে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা। আর ইনডোরে চলে টেবিল টেনিস ও দাবা খেলা। এই কলেজের অনেক শিক্ষার্থী নিয়মিতই আন্তজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ক্রিকেট ও ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেন। ছাত্রীদের জন্য রয়েছে কমনরুম। সেখানে দাবা, লুডুসহ অন্যান্য খেলার সুযোগ আছে।

রোভার স্কাউট, বিএনসিসি ও রেড ক্রিসেন্টের শাখা আছে এই কলেজে। এবার যখন মানিকগঞ্জের ছয়টি উপজেলায় বন্যা হলো, তখন এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শুধু বন্যা নয়, যেকোনো দুর্যোগে মানিকগঞ্জবাসী পাশে পায় কলেজের তরুণ শিক্ষার্থীদের। পুরো শহরেই তাঁরা ছড়িয়ে দেন তারুণ্যের শক্তি, সম্ভাবনা, স্বপ্ন।

ো. শাহজাহান
ো. শাহজাহান

 প্রতিবছর সাময়িকী বের করা হয়
মো. শাহজাহান, অধ্যক্ষ, মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ
আমাদের কলেজ দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বহু কৃতী শিক্ষার্থী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই কলেজকে গৌরবান্বিত করছে। পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মননশীলতা ও চিন্তার স্বাধীনতা বিকাশে উজ্জীবিত করতে শিক্ষকেরা সব সময় সচেষ্ট আছেন। সেই লক্ষ্যে প্রতিবছর সাময়িকী বের করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা, খেলাধুলায়ও আমরা উৎসাহিত করি।