আমরা নর্থ সাউথের শিক্ষার্থীরা যেভাবে ক্যাম্পাসে ফেরার দিনটা উদ্যাপন করলাম
বারো মাসে তেরো পার্বণ—কথাটা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সঙ্গে ভালোই যায়। ২০টিরও বেশি ক্লাব আছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে প্রতিদিন কোনো না কোনো অনুষ্ঠান তো লেগে থাকবেই। আর সেখানেই কিনা কোনো অনুষ্ঠান হয় না প্রায় দুই বছর, ভাবা যায়!
তাই ১৫ মার্চ থেকে যখন ক্যাম্পাসে আবার পুরোদমে ক্লাস শুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত হলো, ভাবলাম এই নতুন করে শুরুটা উদ্যাপন করতে হবে। আমরা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাবের (এনএসইউসিডিসি) সদস্যরা মিলে সিদ্ধান্ত নিই, একটা ফ্ল্যাশমব করব।
প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল আমদের আয়োজনগুলো সম্পর্কে নতুন শিক্ষার্থীদের একটা ধারণা দেব। আমাদের ক্লাবের শিক্ষক উপদেষ্টা প্রিয়াংকা নাথ ম্যামকে ভাবনাটা জানানোর পর তিনি বলেন, ক্যাম্পাস খোলার প্রথম দিনেই যেন আমরা এই ফ্ল্যাশমবের মধ্য দিয়ে সবাইকে স্বাগত জানাই। স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক গৌরগোবিন্দ গোস্বামী স্যারও অনুমতি দিলেন, গান নির্বাচনে সহায়তা করলেন।
কোরিওগ্রাফির দায়িত্ব নিলেন ক্লাবের ইনচার্জ সাদিয়া জাহান। সঙ্গে যোগ হলো রিয়াজ ও রিফাত। সারা দিন ক্লাস শেষে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে শুরু হতো মহড়া। চলত রাত নয়টা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। গানের তালে নেচেছে প্রায় ৫০ জন। পেছনে কাজ করেছে আরও প্রায় ৩০ জন। বিরাট এক মহাযজ্ঞই বলা চলে। ১০ দিনের অনুশীলন আর অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা একদল শিক্ষার্থী ফ্ল্যাশমবের জন্য প্রস্তুত হলাম।
শুরুতে খানিকটা ভয় ছিল। পারব তো? কারণ, এমন অনেক নতুন সদস্য আছে, এর আগে যারা এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি। প্রথম চার থেকে পাঁচ দিন খুব খাটাখাটনি করতে হয়েছে। প্রিয়াংকা ম্যাম বারবার বলছিলেন, ‘আপনারা আমার নাক কাইটেন না! অনেক বড় মুখ করে বলেছি, দারুণ একটা প্রোগ্রাম হবে।’ শেষ পর্যন্ত যে আমরা ম্যামের সম্মান রাখতে পেরেছি, সেটা উপস্থিত শিক্ষার্থীদের কোলাহলই বলে দিয়েছে। শুধু নর্থ সাউথ ক্যাম্পাসেই নয়, ফেসবুকে ফ্ল্যাশমবের ভিডিওর কল্যাণে সারা দেশের মানুষের কাছ থেকেই যে এত সাড়া পাব, ভাবতে পারিনি।
একটা মজার ঘটনাও ঘটেছে। আমাদের কোরিওগ্রাফার সাদিয়া জাহানকে কেউ একজন ভুল করে মহড়াকক্ষে আটকে রেখে চলে এসেছিল। সাদিয়ার কাছে তখন মুঠোফোনও ছিল না। নাচ শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে কোনোরকমে হন্তদন্ত হয়ে সে ভেন্যুতে হাজির হয়েছে।
ফ্ল্যাশমবের সাধারণ নিয়ম হলো কাউকে জানান না দিয়ে হুট করেই একদল মানুষ মিলে একটা পরিবেশনা শুরু করে দেওয়া। কিন্তু আমরা যখন শব্দযন্ত্রের পরীক্ষা করছিলাম, তখনই শিক্ষার্থীরা পায়ে-পায়ে জড়ো হতে শুরু করল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ফ্ল্যাশমব শুরু হতে তখনো প্রায় ৩০ মিনিট বাকি। অথচ আশপাশে তাকিয়ে দেখি ক্যাম্পাসে প্লাজাজুড়ে সবাই এমনভাবে ভিড় করেছে যে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। ভিড় ঠেলে মূল শিল্পীরা যে ভেতরে ঢুকবে, সেই পথ পাওয়া যাচ্ছিল না! কিন্তু একবার নাচ শুরু হওয়ার পর চারদিক ঘিরে থাকা হাজারো শিক্ষার্থী যখন হইহই করে উঠল, বুঝলাম আমাদের আর ভয়ের কিছু নেই।
শুধু ছাত্রছাত্রীরা নয়, বহুদিন পর ক্যাম্পাসে এই মিলনমেলায় হাজির ছিলেন বিশ্ববিদালয়ের সহ-উপাচার্য ইসমাইল হোসেন, কোষাধ্যক্ষ এ বি এম রাশেদুল হাসান, নর্থ সাউথের চারটি স্কুলের ডিন, বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যানসহ শিক্ষকেরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, বিভিন্ন অফিসের পরিচালকেরাও আমাদের উৎসাহ দিতে এসেছিলেন। এই তীব্র রোদ উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁরাও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফ্ল্যাশমব শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় আমাদের শিক্ষকেরা এই পুরো আয়োজনের প্রশংসা করেছেন।
এনএসইউসিডিসিতে আমরা সব সময় বাংলা সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিই। তাই শুরু থেকেই ঠিক করা ছিল, আমরা বাংলা গানের সঙ্গে নাচব। এ ছাড়া সম্প্রতি আলোচিত হওয়া হাজং ভাষার গান ‘নাসেক নাসেক’ও স্থান পেয়েছিল আমাদের তালিকায়।
সব শেষে বলব, আমাদের পরিবেশনার আয়োজক ছিল এনএসইউসিডিসি, ভেন্যু ছিল নর্থ সাউথের ক্যাম্পাস, কিন্তু এর ইতিবাচকতা আমরা ছড়িয়ে দিতে চাই সারা দেশের সব কটি ক্যাম্পাসে। আমাদের ক্যাম্পাসগুলো আবার জীবন্ত হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা ফিরছে প্রাণের প্রাঙ্গণে। তারুণ্যের এই উচ্ছ্বাসে গত দুই বছরের সব না পাওয়া, আক্ষেপ, গ্লানি যেন মুছে যায়—এটাই চাওয়া।