জাপানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিচের সব পর্যায়ের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম গত বছরের এপ্রিল থেকেই চালু আছে। তাই বাংলাদেশে এই স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে জাপানের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে (বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম চালু আছে)। আমি কয়েক বছর ধরে এই স্তরে শিক্ষকতা করছি আবার আমার মেয়েও এখানকার প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী। তাই শিক্ষক ও অভিভাবক উভয় ক্ষেত্রেই এই পরিস্থিতি মোকাবিলার সরাসরি অভিজ্ঞতা আমার আছে। সেগুলোর কিছু এখন শেয়ার করব।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের সূচনার দিকে যখন কারও কাছেই পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না, তখন মার্চের প্রথমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে বন্ধ ঘোষণা করেন। তবে তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় নিয়োজিত শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিয়মিতই কাজ করতে হয়েছে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করে। জাপানে শিক্ষাবর্ষ শেষ হয় মার্চে। তাই গত বছর বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর আনুষ্ঠানিক গ্র্যাজুয়েশন সেরেমনি হয়নি। তবে মার্চের শেষ দিক থেকেই কিছু ডেটা আসতে থাকে যে ১৮ বছরের নিচের ক্ষেত্রে সংক্রমণের হার বেশ কম। তাই যেসব এলাকায় সংক্রমণের হার কম ছিল, সেসব এলাকায় এপ্রিলের প্রথম থেকেই এবং অন্যান্য এলাকায় জুনের মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়। কারণ, তত দিনে ১৬ বছরের নিচের ক্ষেত্রে নিম্ন সংক্রমণ-সংক্রান্ত যথেষ্ট তথ্য নীতিনির্ধারকদের কাছে চলে আসে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। যেমন প্রতিদিন সকালে সবার শরীরের তাপমাত্রা মেপে নির্দিষ্ট ফরমে লিপিবদ্ধ করা (৩৭.৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা হলে বা সর্দি-কাশি থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না যাওয়া), বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহার করা, বড় ধরনের সমাবেশ না করা, যথাসম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, দিনে বেশ কয়েকবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া প্রভৃতি। এ ছাড়া প্রাথমিকভাবে অর্ধদিবস, সপ্তাহে তিন দিন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে সপ্তাহ দুয়েক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পূর্ণোদ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়। তখন থেকে শুরু করে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় নির্বিঘ্নেই সারা দেশে শিক্ষা কার্যক্রম চলেছে। বরং এ সময়ের মধ্যে অন্যান্য ফ্লুর অসুখের হারও বেশ কমে গেছে। একই সঙ্গে একটি বড় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য মনিটর করা সহজ হয়েছে।
নতুন বছরে আবার সারা দেশে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বড় কয়েকটি শহরে আবার জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। তবে এবার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়নি। জরুরি অবস্থা জারি করলেও আসলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তন যা হয়েছে মূলত রেস্তোরাঁ, নাইট ক্লাব বা পাব রাত আটটার মধ্যে বন্ধ করতে অনুরোধ করা হয়েছে। অতি প্রয়োজন ছাড়া জরুরি অবস্থা জারি করা শহরের মানুষকে শহরের বাইরে যেতে এবং বাইরের মানুষকে শহরে আসতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আর মানুষ আরেকটু বেশি সতর্ক হয়েছে, যার ফলে সুপারমার্কেট বা অন্যান্য বিনোদন ক্ষেত্রে মানুষের বিচরণ কিছুটা কমেছে। আর বাকি জীবনযাত্রায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে তা হলো, এখন আরও ঘন ঘন হাত ধোয়া হচ্ছে, পেয়ার বা গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি যথাসম্ভব কম করা হচ্ছে। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের ভেতরে ও বাইরে স্যানিটাইজার বা ৭০ শতাংশ অ্যালকোহল রাখা হয়েছে। কোনো কক্ষে ঢুকতে হলে স্যানিটাইজার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কথা বলার ক্ষেত্রে সম্ভব হলে ১-২ মিটার দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে নিয়মিত কার্যক্রম কোনোটিই বন্ধ হয়নি। যার ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বলতে গেলে কোনো প্রভাবই পড়েনি।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে শিক্ষার্থীদের লকডাউন করা হয়নি এবং ১৮ বছরের নিচের কাউকে আপাতত টিকা দেওয়া হবে না, সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাই ১৮ বছরের নিচের সবার নিম্ন সংক্রমণ, জটিলতা ও মৃত্যুহার বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিচের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনতিবিলম্বে খুলে দেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে নিচের সতর্কতা ও প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে—
১.
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট সবার শরীরের তাপমাত্রা কমপক্ষে এক সপ্তাহ প্রতিদিন মনিটর করতে হবে। এক সপ্তাহ পর যাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়মিত ৩৭.৫ ডিগ্রির নিচে থাকবে, তাদের নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে।
২.
প্রথমে অর্ধবেলা কার্যক্রম দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। সপ্তাহখানেক এক দিন পর এক দিন করে কার্যক্রম চালিয়ে পরবর্তী সপ্তাহে প্রতিদিন অর্ধবেলা করে এবং এরপর পূর্ণ কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে।
৩.
সবার জন্য শরীরের তাপমাত্রা লিপিবদ্ধ করার জন্য ফরম তৈরি করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশমুখে সব শিশুর তাপমাত্রা মেপে ফরমে লিখে অন্যান্য শারীরিক অবস্থার কথা শুনে (যেমন সর্দি/কাশি) নিশ্চিত হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করতে দেওয়া যেতে পারে।
৪.
সব সময় মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশমুখে ও প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করতে হবে ও ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থানের সময় কমপক্ষে তিনবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
৫.
শিক্ষকদের ওপর কিছুটা অতিরিক্ত চাপের সৃষ্টি হবে স্বাভাবিকভাবেই। তাই তাদের অতিপ্রয়োজনীয় শিক্ষা কার্যক্রমের কাজ ছাড়া অন্যান্য কাজ থেকে ছাড় দিতে হবে। দৈনিক ক্লাসের সংখ্যাও একটু কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। শিক্ষকসমাজকে কোভিড-১৯-এর সম্মুখযোদ্ধার মর্যাদা দিয়ে তাঁদের ভ্যাকসিন প্রাপ্তি ও চিকিৎসা সুনিশ্চিত করা যেতে পারে। কিছু অতিরিক্ত প্রণোদনাও ঘোষণা করা যেতে পারে।
জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। বাংলাদেশ সরকার কোভিড-১৯-এর প্রাথমিক পর্যায়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকি যথাসম্ভব কমাতে প্রশংসনীয়ভাবে সক্ষম হয়েছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জনগণের মৌলিক অধিকার শিক্ষার কার্যক্রম পুনরায় চালু করতেও সরকার সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেবে বলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
লেখক: ড. মো. মোসাদ্দেকুর রহমান, পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো, কাগোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক, এবিনো শিক্ষাবোর্ড, জাপান