পড়ালেখার পাশাপাশি আয় করতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী সহপাঠীদের তুলনায় একটু পিছিয়ে পড়েন। কিন্তু আত্মনির্ভরশীলতার আনন্দ তাঁদের কাছে বড়। ছবিটি প্রতীকী।

‘তোমাকে আর আসতে হবে না’, মাসের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ এ কথা শুনে জান্নাতুল ফেরদৌসের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। ২০২০ সালের মার্চ মাস। করোনার প্রকোপ তখন সবে টের পেতে শুরু করেছে দেশ। হুট করে দুটি টিউশনিই চলে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এই শিক্ষার্থী।

কিন্তু নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়ার প্রত্যয়েই তো ঢাকায় পড়তে এসেছেন মানিকগঞ্জের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস। বাসাভাড়া, খাওয়া, পড়ালেখা—সবকিছুর খরচ নিজের কাঁধে নিয়েছেন। করোনার আঘাত তাঁকে কিছুটা এলোমেলো করে দিলেও হার মানেননি। গত বছর অক্টোবর মাস থেকে আবার টিউশনি শুরু করেছেন। এখন আবার জান্নাতুল মাথা উঁচু করে বলেন—আমার টিউশন ফি আমিই দিই।

জান্নাতুলের মতো অনেক শিক্ষার্থীই স্নাতক পর্যায়ে এসে আত্মনির্ভরশীল হতে চান। কেউ পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে, কেউবা নিজের তাগিদে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের এমন ১৮ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে, যাঁরা পড়ালেখার পাশাপাশি আয় করছেন, নিজের পড়ালেখার খরচ নিজেই বহন করছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীও সেমিস্টারের শুরুতে বড় অঙ্কের টিউশন ফি নিজের পকেট থেকে দেওয়ার সাহস করছেন, চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন।

শুধু টিউশনি নয়

যে শিক্ষার্থীরা ছাত্রজীবন থেকে আয় করেন, তাঁদের অধিকাংশই টিউশনির ওপর নির্ভরশীল। তবে করোনাকাল এই বাস্তবতায় কিছুটা পরিবর্তন এনে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, টিউশনির সুযোগ কমেছে বলে অনেকেই ভিন্ন আয়ের পথ খুঁজে নিয়েছেন।

‘টিউশন স্পেস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা শামীম কাওসার। ২০১৭ সালে তিন বন্ধু মিলে এই প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলেন। তাঁরা মূলত ছাত্রছাত্রী এবং হোম টিউটরদের মাঝখানে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেন। শামীম বলেন, ‘এখন যাঁরা হোম টিউটর খোঁজেন, তাঁদের বেশির ভাগের সন্তানই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েন। বাংলা মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হোম টিউটর রেখে পড়ালেখা করার প্রবণতা অনেকটা কমে গেছে। তবে হ্যাঁ, করোনার শুরুতে যে ধাক্কাটা এসেছিল, সেটা কাটিয়ে ওঠা গেছে। অনেকে এখন অনলাইনে ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে আয় করছে।’

কলেজজীবন থেকেই টিউশনি করে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে চেয়েছেন হুমায়রা আহমেদ। ঝোঁকের বশে যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখনো জানতেন না, টিউশনি করে টিউশন ফি জোগানো কঠিন হবে। তবু ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্থাপত্য বিভাগে।

উপার্জনের শুরুটা টিউশনি দিয়ে হলেও একসময় বাচ্চাদের একটি স্কুলে আর্টের শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর লালমাটিয়ার ফিনিক্স ওয়ান্ডার উইমেনে কাজ করেন কর্মজীবী নারীদের আর্টের শিক্ষক হিসেবে। একই সময়ে ‘স্টুডিও চিড়িয়াখানা’ নামে একটি প্রোডাক্ট ডিজাইন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। বেশ কয়েকটি প্রকাশনীর সঙ্গে বইয়ের প্রচ্ছদের কাজ করেছেন। স্থাপত্যের তৃতীয় বর্ষে ভাস্তু আর্কিটেক্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। পড়ালেখার পাশাপাশি এখন একই সঙ্গে ব্যবহারিক জ্ঞানও যোগ হচ্ছে তাঁর ঝুলিতে।

হুমায়রা বলেন, ‘যেখানে প্রথম বর্ষে নিজে আয় করে পড়ালেখা করা অসম্ভব মনে হতো, সেখানে স্থাপত্যে চার বছর পার করে ফেলেছি ভাবলেও অবাক লাগে।’ পরিবার ও শিক্ষকদের সহায়তাই সাহস জুগিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

আত্মনির্ভরশীলতার আনন্দ

ঢাকার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষের এক ছাত্রের সঙ্গে কথা হলো। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে চট্টগ্রামের এই তরুণ বলেন, ‘যেহেতু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি, তাই জেদ করে ঠিক করেছিলাম নিজের খরচ নিজে দেব। প্রথম বর্ষ থেকেই তিন-চারটা টিউশনি শুরু করি। মা-বাবা প্রথমে ভালোভাবে নেননি। তাঁরা শুধু পড়ালেখায় মনোযোগী হতে বলতেন। ওপেন ক্রেডিট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি ভালো দিক হলো, নিজের পছন্দের সময়ে কোর্স নেওয়া যায়। আমিও সবকিছুর ভারসাম্য রেখেই এগিয়েছি। কোনো সেমিস্টারে হয়তো একটা কোর্স কম নিতে হয়েছে, কিন্তু আমি মানিয়ে নিয়েছি।’

প্রতিদিন তিনি সাইকেল চালিয়ে টিউশনিতে যান। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করেন। অনেক বন্ধুর হয়তো তাঁর আগেই স্নাতক শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে ব্র্যাকের এই শিক্ষার্থীর আক্ষেপ নেই। আত্মনির্ভরশীলতার আনন্দই তাঁর কাছে বড়।

ছাত্রজীবন থেকেই নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়ার চর্চা ভবিষ্যতে একজন শিক্ষার্থীকে এগিয়ে রাখবে বলেই মনে করছেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ফারিনা হক। তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থী যখন আয় করা শুরু করে, তখন সে দায়িত্ব নেওয়া শেখে। অভিভাবকের কষ্টার্জিত আয়ের মূল্য বুঝতে শেখে। এই শিক্ষা তাঁর জীবনযাপনের ওপর প্রভাব ফেলে।’