খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা গবেষণা ছাড়াও যেখানে অনন্য
শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক স্তরের একজন শিক্ষার্থীর মনের সুপ্ত বাসনাই থাকে নিজেকে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হিসেবে দেখা। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না।
স্কুলজীবনে বাসার ছাদ থেকে বাবা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু ভবনগুলো দেখিয়ে বলতেন, ‘আমার ছেলেটা যদি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারত!’ তা ছাড়া শিক্ষাজীবনের শুরুটা খুলনায় হওয়ায় চলার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দরজা প্রায়ই চোখে পড়ত এবং মনে মনে ভাবতাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কতই না ভাগ্যবান! দূর থেকে তাকিয়ে থাকতাম তাঁদের দিকে! অবশেষে ২০০৬ সালে সেই স্বপ্ন এসে ধরা দিল।
প্রথমে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা করা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু জ্ঞানের পাঠ দেওয়া হবে, বিষয়টি তেমন নয়। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে প্রায়োগিক ও মৌলিক জ্ঞানের সৃষ্টি করা যেগুলো কেবল শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ না থেকে সামগ্রিক জ্ঞানতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিসরে বিস্তৃত করা। আমরা যদি এই উপমহাদেশের প্রসঙ্গে আসি, তবে আরও শত শত বছর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।
উপমহাদেশ তথা বিশ্বের প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয় তক্ষশীলা ও নালন্দার কথা জানতে পারি যা ছিল বৌদ্ধ, হিন্দু, জৈন যুগের শিক্ষা ও সভ্যতার হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বল নিদর্শন। ভাষা, ব্যাকরণ, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, ধনুর্বিদ্যা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, জ্যোতিঃশাস্ত্র, হিসাববিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, গান, নাচ, হস্তশিল্প ইত্যাদি উন্নত কারুশিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশের তীর্থস্থান ছিল এসব প্রাচীন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
চাণক্য, সম্রাট চন্দ্রগুপ্তসহ অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তির নাম এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তৎকালে ওই প্রথিতযশা মানুষদের অবদান পাঠ্যপুস্তকের গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তব জীবনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল বলে জানা যায়। মোদ্দা কথা, হাজার বছর পূর্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল সমাজকাঠামো তথা মানুষের জীবনমানের অগ্রগতি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলির উৎকর্ষ সাধনও এর অংশ। আর আমাদের বাংলাদেশ নামক দেশটির সৃষ্টির পেছনে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা কারোরই অজানা নয়।
এবার আসা যাক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে। আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ নভেম্বর ৪টি পাঠ্যবিষয়ের ৮০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ১৯৯১ সালে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টি স্কুল (অনুষদ) রয়েছে। এখানে মোট ২৯টি ডিসিপ্লিনে (বিভাগ) শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আজ ৩ (তিন) দশক অতিক্রম করছে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা অর্থাৎ মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টি এবং সমাজে এর প্রভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ রয়েছে। দেশ–বিদেশের বুদ্ধিজীবীরা প্রায়ই এসব বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন। কিন্তু, আজ একটু ভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রথমেই যে বিষয় শিক্ষার্থীদের নজরে পড়বে সেটি হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার দিন কোনো রাজনৈতিক দলের স্লোগানসংবলিত কর্মকাণ্ডের অনুপস্থিতি। হোক সেটি আপনাকে স্বাগত জানানো বা সহায়তামূলক কর্মকাণ্ডের ব্যানারে! তার মানে কি এখানে ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রী তথ্যের অভাবে দিশাহীন ঘুরাঘুরি করবেন? না, তাঁদের সহায়তার জন্য প্রস্তুত থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রীদের দ্বারা পরিচালিত অরাজনৈতিক ৩০–এর অধিক সংগঠন এবং সঙ্গে থাকে বিএনসিসিসহ কিছু অঞ্চলভিত্তিক সংগঠন। এখানে ছাত্ররাজনীতি নেই, তবুও কেউ পিছিয়ে নেই নেতৃত্বদানে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদের উত্থান, হলি আর্টিজান হামলা ও শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে হামলার প্রতিবাদ, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, পরিবেশ রক্ষাসহ নিজেদের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলনসমূহ সেই ইঙ্গিত বহন করে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বদানের গুণাবলি প্রদান করে।
তবে এখানেও অনেক পোস্টার বা ব্যানার চোখে পড়বে। সেগুলো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংগঠন আয়োজিত অনুষ্ঠানমালা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অসুস্থ শিক্ষার্থীর সাহায্যের জন্য মানবিক আবেদনসহ গৃহীত কর্মসূচি। ভর্তি হওয়ার পরপরই দেখেছি এক ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য আয়োজিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং অর্থ সংগ্রহ কার্যক্রম, যা আমাদের মধ্যে একটি বোধই জাগ্রত করতে সাহায্য করেছে। আর তা হলো মানুষ মানুষের জন্য। এ ছাড়া দেখেছি অনেক দিবসভিত্তিক সাংস্কৃতিক আয়োজন। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে পয়লা বৈশাখের আয়োজন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিণত করেছে দক্ষিণবঙ্গের একটি সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্রে, যেখানে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়, যার মঙ্গল শোভাযাত্রা শহরের প্রাণকেন্দ্র প্রদক্ষিণ করে এবং যেখানে সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ চোখে পড়ে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বা গবেষণার পরিবেশ অনেকটাই ঈর্ষণীয়। যদিও জায়গা সংকট এ বিষয়কে কিছুটা জটিল করে তোলে, তবুও শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এই সীমাবদ্ধতা অনেকটা দূর হয়ে যায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় যে শুধু পড়াশোনার জায়গা নয়, সেটা এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে প্রথমেই বুঝিয়ে দিয়েছিল ২০০৭ সালে, যখন প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের থাবায় দেশের দক্ষিণাঞ্চল বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা সেদিন বেরিয়ে পড়েছিলেন বাক্স হাতে অর্থ, খাদ্য ও পোশাক সংগ্রহে। কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকারের সাহায্য ছাড়াই খুলনা শহরের আনাচে–কানাচে চলে সংগ্রহ অভিযান। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে করে শিক্ষার্থীরা সেগুলো বাগেরহাটের শরণখোলায় নেন। দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষদের দিকে তাকিয়ে তাদের জন্য কিছুটা করতে পেরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রের একজন হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছিল সেদিন।
এ ছাড়া প্রতি শীতে প্রতিটি একাডেমিক ভবন, হল বা ক্যাফেটেরিয়াতে দেখা যায় শীতার্তদের জন্য শীতবস্ত্র সংগ্রহের বাক্স। এসব বাক্স ছাত্র–ছাত্রীরা শহরের বাইরে নিয়ে যান শীতবস্ত্র সংগ্রহের জন্য। কখনো নিউমার্কেট, কখনো ডাকবাংলো অথবা শিববাড়িতে বাক্স হাতে খুবির ছাত্র-ছাত্রীদের দেখলে অবাক হতাম না বরং গর্বে বুকটা ভরে উঠত। কারণ তাঁদের হাতেই তো ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব। ভৌগলিকভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের কাছে অবস্থিত হওয়ায় ২০০৯ সালে আইলার ভয়াবহতাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা কাছ থেকে দেখেছিলেন এবং একাডেমিক কাজের বাইরে গিয়ে সেখানেও তাঁদের অবদান ছিল চোখে পড়ার মতো।
করোনা মহামারির সময় সমাজের অসহায় হতদরিদ্র মানুষকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার। সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক সহায়তার দৃষ্টান্ত এই উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান। আলেকজান্ডার যখন উপমহাদেশ আক্রমণ করেন, তখন সহায়–সম্বল হারিয়ে হাজার হাজার মানুষ জীবন বাঁচাতে তক্ষশীলায় আশ্রয় নেয়। উদ্ভূত প্রেক্ষাপটে তক্ষশীলার রাজা কর্তৃক আয়োজিত সভায় উপস্থিত শিক্ষকমণ্ডলী সহায়–সম্বলহীন মানুষদের তক্ষশীলার ভূমি প্রদানে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। সুতরাং মানবিক দিকগুলো তৎকালীন প্রেক্ষাপটেও উপেক্ষিত থাকেনি।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি পর্যালোচনা করলেও তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সংশ্লিষ্টতার সুদীর্ঘ ইতিহাস পাওয়া যায়। সুতরাং বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এমন ভূমিকা দেশ ও জনগণের জন্য যেমন ইতিবাচক তেমনি আশাজাগানিয়াও বটে।
একসময় শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নিতে হয় কিন্তু শেষ করেও যে শেষ হতে দিতে চান না খুবিয়ানরা। এর পরপরই শুরু হয় এই প্রাণের বিদ্যাপীঠকে হৃদয়ে ও মননে ধারণ করার পালা। তার জন্য কখনো দেখা যায় ব্যক্তি উদ্যোগ, আবার কখনো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এখান থেকে ডিগ্রি নিয়ে দেশে–বিদেশে অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন সাবেক শিক্ষার্থীরা। উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন দেশে বিশ্বের নামকরা বিভিন্ন বৃত্তি অর্জন করে সাফল্যের প্রমাণ দিতে সক্ষম হচ্ছেন তাঁরা। বিভিন্ন স্বনামধন্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ইতিমধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন অনেক খুবিয়ান।
শিক্ষা-গবেষণার মান বা পরিবেশের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান সম্পর্কে ধারণা নিতে গেলে নজর দেওয়া যেতে পারে স্পেনের সিমাগো ল্যাব ও যুক্তরাষ্ট্রের স্কপাস পরিচালিত বিশ্বের ৭০২৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত (ইনডেক্স জার্নালভিত্তিক) জরিপের দিকে, যেখানে কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রথম দিকে স্থান করে নিচ্ছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে সবার মনে একটা আক্ষেপ থেকেই যায়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে কোভিড-১৯ টিকার সফল ট্রায়াল দিচ্ছে, সেখানে আমরা আমাদের নিজেদের অবস্থান কোথায় দেখতে পাচ্ছি? সর্বোপরি, আমরা স্বপ্ন দেখি এই কারণে, যেখানে প্রতিবছর এমন মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন দেশপ্রেমিক ছাত্র-ছাত্রী তৈরি হচ্ছে, তাঁদের যদি রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করা যায় তাহলে তাঁদের হাত ধরেই দেশ এগিয়ে যাবে। কারণ, এ দেশে যে মেধা আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ এবং পৃষ্ঠপোষকতার। তাহলেই শিক্ষা-গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে এই উৎকৃষ্ট মানবিক গুণাবলির সংমিশ্রণ আমাদের দেশকে নিয়ে যাবে অনেক দূর। দক্ষিণবঙ্গের এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠের তিন দশক পূর্তি এবং বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে রইল অনেক অনেক শুভকামনা।
*লেখক: পিএইচডি গবেষক, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, টোকিও, জাপান ও সহকারী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়