পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকায় অফিস নয়, নিয়োগে সতর্কতা

অনিয়ম বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একগুচ্ছ নির্দেশনা ইউজিসির। নিয়মের বাইরে জনবল নিয়োগ দিলে বেতন নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)
ফাইল ছবি

ঢাকার বাইরে অবস্থিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় রাজধানীতে লিয়াজোঁ অফিস, সিটি অফিসসহ একাধিক নামে অফিস চালাচ্ছে। কোনো কোনো উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে না গিয়ে এসব অফিসে বসে দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ‘গেস্টহাউস’ ছাড়া কোনো লিয়াজোঁ অফিস বা অন্য কোনো নামে ঢাকায় অফিস রাখতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস বা ঠিকানায় প্রশাসনিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত কার্যক্রম চালাতে হবে। আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রকল্প অফিসে প্রশাসনিক কার্যক্রম করতে হবে।

দেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর্থিক অনিয়ম বন্ধের জন্য ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া নিয়োগ না দেওয়া, ভর্তি ফরম বাবদ আয় হওয়া টাকা শৃঙ্খলায় আনা, যাকে-তাকে সম্মানী না দেওয়াসহ এ রকম একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাজেট ব্যবহারে অনুসরণীয় গাইডলাইনসমূহ’ নামে সম্প্রতি এসব নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে পাঠিয়েছে ইউজিসি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক স্বায়ত্তশাসন আছে, কিন্তু আর্থিক ক্ষেত্রে সেটা নেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের আর্থিক বিধিবিধান, নিয়মাবলি ও পিপিআর অনুসরণ করতে হবে।
অধ্যাপক মো.আবু তাহের, সদস্য, ইউজিসি

ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা রকম আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেটের এই সময়ে নিয়মকানুন মেনে চলতেই মূলত এই নির্দেশনাগুলো দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে সারা দেশে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৯টি। এগুলোর মধ্যে জাতীয়, উন্মুক্ত এবং ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বাকিগুলোতে প্রায় তিন লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। মোট শিক্ষক সাড়ে ১৫ হাজার।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভাপতি এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ইউজিসির নির্দেশনাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে উপস্থাপন করা হবে। সেখানেই করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

পড়াশোনা চলছে
ফাইল ছবি

ইউজিসি বলছে, ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ, অনুষদ বা ইনস্টিটিউট খোলার নিয়ম নেই। কিন্তু কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এই নিয়ম না মেনেই বিভাগ খুলছে বলে অভিযোগ আছে। যেমন গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইউজিসির অনুমোদন ছাড়াই ইতিহাস বিভাগ খুলেছিল, যা নিয়ে পরে জটিলতার সৃষ্টি হয়, বেকায়দায় পড়েন শিক্ষার্থীরা। এ জন্য ইউজিসি বলছে, ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া কোনো নতুন বিভাগ, অনুষদ বা ইনস্টিটিউট খোলা যাবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের আয় (ছাত্র ভর্তি ফি, টিউশন ফি, পরীক্ষাসংক্রান্ত ফি, ল্যাব টেস্টিং ফি, বিশেষ কোর্স থেকে আয়, বেতন থেকে কর্তনাদি, সম্পত্তি থেকে আয় ইত্যাদি) নিজস্ব আয়ের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে বাজেটে দেখাতে বলেছে ইউজিসি। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি।

অনুমোদনহীন নিয়োগে বেতন নয়

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে খেয়ালখুশিমতো নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহান ১৩৮ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে কেলেঙ্কারি করে যান। যার জেরে এখনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি চলছে। আরও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ রকম অবস্থায় ইউজিসির পূর্ব অনুমোদন ছাড়া অ্যাডহক (অস্থায়ী), দৈনিকভিত্তিক, মাস্টাররোল, নিরাপত্তাকর্মী, আনসার, আউটসোর্সিং নিয়োগ দিতে নিষেধ করেছে সংস্থাটি। নিয়মের বাইরে কর্মরত জনবলের বেতন ইউজিসি থেকে বরাদ্দ দেওয়া হবে না ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের আগের কোনো শূন্য পদ এবং নতুন সৃষ্ট পদ পূরণের জন্য অবশ্যই ইউজিসির অনুমোদন নিতে হবে।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত স্কুল ও কলেজের জনবল কোনো অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।

ভর্তি ফরমের টাকা শৃঙ্খলায় আনতে নির্দেশ

অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি বাবদ আয়ের বিরাট অঙ্কের টাকা সম্মানীর নামে শিক্ষকসহ ভর্তি কমিটির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ভাগ করে নেন। এ জন্য ইউজিসি বলেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি বাবদ মোট আয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ বাবদ আয়ের সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ টাকা ভর্তিসংক্রান্ত কাজে (ব্যাংক অথবা মোবাইলসহ যেকোনো সেবা নেওয়ার খরচসহ) ব্যয় করা যাবে। বাকি ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দিয়ে পরিচালন খাতে ব্যয় করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনে বসবাসরত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি বিলের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো রূপ ভর্তুকি দেওয়া যাবে না।

অডিট আপত্তির টাকা কেটে পেনশন

ইউজিসি বলেছে, অবসরে যাওয়া শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অডিট আপত্তির টাকা কেটে পেনশনের টাকা দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির ওপর ভিত্তি করে কেটে রাখা টাকা পরিশোধ করা যাবে।

শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্ব ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুযায়ী মূল বেতনের ১০ শতাংশ অথবা ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে যা কম হবে, তা দিতে হবে। অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা দেওয়া যাবে না।

ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মো. আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক স্বায়ত্তশাসন আছে, কিন্তু আর্থিক ক্ষেত্রে সেটা নেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের আর্থিক বিধিবিধান, নিয়মাবলি ও পিপিআর অনুসরণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্যে আনার জন্য এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা আশা করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালন করবে।