ফিল্মের ছাত্র, ছাত্রদের ফিল্ম
‘আড্ডা উইথ টিম মনোজ’—গুগল মিট সফটওয়্যারে এই ছিল আমাদের মিটিংয়ের ‘টাইটেল’। নামকরণ যে ভুল হয়নি, সেটি অভিনেতা মনোজ প্রামাণিকের প্রথম কথাতেই বোঝা গেল। অনলাইন আলাপের শুরুতে তিনি বলেন, ‘এটা কারও একার প্রজেক্ট নয়। আমরা সবাই মিলে কাজ করেছি। লিখতে হলে সবার কথা লিখতে হবে।’
ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাককানইবি) ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষক—অভিনেতা মনোজ প্রামাণিক। তাঁর নেতৃত্বে সম্প্রতি জাককানইবির একদল শিক্ষার্থী মিলে ১৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি তৈরি করেছেন। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আলফা আই ও এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার শাকিলের সহায়তায় ছবিগুলো মুক্তি পেয়েছে দীপ্ত টিভি ও একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। মামুনুর রশীদ, তারিন, তাসনুভা তিশা, শিল্পী সরকার অপু, সাবিলা নূর, ইয়াশ রোহান, খায়রুল বাশারের মতো অভিনয়শিল্পীরা শিক্ষার্থীদের বানানো ছবিতে কাজ করেছেন। ‘৭ দুগুণে ১৪’ নামের এই প্রকল্প প্রশংসিতও হয়েছে বেশ। সেই সূত্র ধরেই মনোজদের সঙ্গে আড্ডা।
ক্যাম্পাসের ছবি
১৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি তৈরির পেছনে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছেন ২০ শিক্ষার্থীর একটি দল। সবাই ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়ার ছাত্র। তবে তাঁদের সঙ্গে জাককানইবি পরিবারের আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্ররা যেমন কোনো কোনো ছবিতে সেট ডিজাইনে সহায়তা করেছেন। আবার কলাকুশলীর তালিকায় শুধু নাট্যকলা নয়, আছেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল কিংবা অর্থনীতির শিক্ষার্থীরাও।
কদিন আগেই জাককানইবি থেকে স্নাতক শেষ করেছেন এ বি মামুন। ‘৭ দুগুণে ১৪’ প্রকল্পে নওমহল নামে একটি ছবির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। শুটিং হয়েছে ক্যাম্পাস এলাকায়। কলাকুশলীদের মধ্যে শিক্ষার্থীরা তো ছিলেনই, অভিনয় করেছেন তিনজন শিক্ষকও। পরিচালক হিসেবে শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? জানতে চাইলে বলেন, ‘ক্যামেরা অন হলে আর মনে থাকে না কে শিক্ষক, কে ছাত্র। তখন শুধু মাথায় থাকে আমি শটটা যে রকম চেয়েছি, সে রকম পাচ্ছি কি না।’
চর্চা চলে সব সময়
জাককানইবিতে সংস্কৃতিচর্চার আবহ থাকে সারা বছর। ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়ার শিক্ষার্থীরা জানালেন, প্রথম বর্ষ থেকেই তাঁরা’ বড় ভাই-আপুদের’ বিভিন্ন প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। করোনাকালেও এই চর্চা থেমে ছিল না। গত বছর যে যাঁর ঘরে বসেই শিক্ষার্থীরা ছবি বানিয়েছেন, আয়োজন করেছেন ‘চলচ্চিত্র উৎসব’।
৭ দুগুণে ১৪ প্রকল্পের পরিচালকদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ইশতিয়াক জিহাদ। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন তিনি। তাঁর ছবির নাম বিড়াল তপস্যা। বলছিলেন, ‘সবার ছোট বলে আমি বোধ হয় কিছুটা সুবিধাই পেয়েছি। আমার কাজটাতে বড় ভাইদের বিশেষ সহযোগিতা ও যত্ন ছিল।’ ১৪টি ছবির জন্য আলাদা করে ১৪ জন পরিচালক থাকলেও ঘুরেফিরে সবাই সবার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দলের একমাত্র নারী সদস্য হুমায়রা স্নিগ্ধা যেমন সবগুলো ছবির কস্টিউম ডিজাইন করেছেন। শুক্রবার নামে একটা ছবি পরিচালনাও করেছেন তিনি।
মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি
করোনা, লকডাউন—এসবের মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে ছবি বানাতে গিয়ে বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। তার ওপর ক্লাস-পরীক্ষা তো ছিলই। ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই ক্যাম্পাসের আশপাশে থাকেন। গল্প সাজানো, শুটিং বা পোস্ট প্রোডাকশনের কাজে ঢাকায় এসে যাঁদের থাকতে হয়েছে, তাঁরা উঠেছিলেন মনোজ প্রামাণিকের বাসায়। ‘স্যার’–এর বাসায় থেকে দল বেঁধে তাঁরা কাজ করেছেন। চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ইকবাল হাসান খান বলছিলেন, ‘স্যারের বাসায় যতক্ষণ ছিলাম, কাজের মধ্যে ছিলাম। ভেবে দেখুন, ১৪ জন মানুষ মাথায় ১৪টা গল্প নিয়ে ঘুরছে। আবার মাঝেমধ্যেই একজন আরেকজনের গল্পের ভেতর ঢুকে পড়ছে। সব মিলিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।’ জানিয়ে রাখি, ইকবালের বানানো ছবিটির নাম আনোয়ারা মনোয়ারা। জাককানইবির ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক মেহেদী উল্লাহর লেখা গল্প অবলম্বনে তিনি বানিয়েছেন এই চলচ্চিত্র।
শিক্ষার্থীদের কথায় বারবার এল ‘মনোজ স্যার’–এর প্রতি কৃতজ্ঞতা। পুরো প্রকল্পে মনোজ ছিলেন ক্রিয়েটিভ প্রডিউসার হিসেবে। এ ছাড়া তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মনপাচিত্রের হাত ধরেই শিক্ষার্থীদের স্বপ্নটা বাস্তবায়ন হয়েছে। পরিচালকদের মধ্যে আরও ছিলেন রাহিল রহমান, জিডি মজুমদার, শফিকুল সাজীব, মুনসিফ উজ জামান, গোলাম মুন্তাকিম, আহসাবুল ইয়ামিন, মানব মিত্র, হাসিব আহমেদ, শ্রী অভীক চন্দ্র তালুকদার ও সিজু শাহরিয়ার। প্রকল্প সমন্বয়ক পার্বণ মাজহার, লাইন প্রডিউসার ইমন বিন আনোয়ার, শিল্প নির্দেশক মম রাখাইন কিংবা চিত্রগ্রাহক সামিউল সুপ্তক—সবাই জাককানইবির ছাত্র।
৭ দুগুণে ১৪ তো হলো। এরপর কী? মনোজ প্রামাণিক এককথায় বলেন, ‘আমরা ফিল্মের সঙ্গে থাকতে চাই।’ আর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আলফা আইয়ের পক্ষ থেকে নির্বাহী প্রযোজক এজাজ উদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, ‘৭ দুগুণে ১৪ প্রশংসিত হওয়ায় আমাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। এরপর আমরা আরও ৫০ জন নবীন পরিচালককে নিয়ে কাজ করব।’ পরবর্তী প্রকল্পের জন্য নবীন নির্মাতারা চাইলে [email protected] ই–মেইলে গল্প ও পরিকল্পনা পাঠাতে পারেন।
ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে ছাত্রছাত্রীরা চলচ্চিত্র তৈরির প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। ১৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করে তাঁরা তাঁদের শেখাটার বাস্তব প্রয়োগ যে করল, সে জন্য আমি তাঁদের সাধুবাদ জানাই। একই সঙ্গে যে শিক্ষক এই উদ্যোগ নিয়েছেন, তাঁকেও শ্রদ্ধা জানাই। এই শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে বড় চলচ্চিত্র নির্মাতা হবেন ও ভালো করবেন। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ রয়েছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এ ধরনের ব্যবহারিক কাজ আরও বেশি করা উচিত। এতে দেশের চলচ্চিত্রশিল্প উপকৃত হবে। এ ধরনের সৃজনশীল উদ্যোগে সব ধরনের সহযোগিতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা হবে।অধ্যাপক এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান, উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়