বিদেশে অধ্যাপক হতে পিএইচডির সময়টা কাজে লাগানো জরুরি

উন্নত বিশ্বে দেখা যায়, পিএইচডি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেওয়ার পর অনেক বছর লেগে যায় অধ্যাপক হতে। সর্বোচ্চ এই অবস্থানে যেতে উচ্চমানসম্পন্ন গবেষণা এবং পাবলিকেশন ছাড়াও প্রয়োজন হয় একাডেমিক লিডারশিপের। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এবারডিনের অধ্যাপক ম আজিজুল ইসলাম। যেখানে পিএইচডি শেষ করে ১০ বছরে অধ্যাপক হওয়ার ঘটনা বিরল, সেখানে মাত্র ৮ বছরেই গবেষণা ও কর্মদক্ষতা দেখিয়ে অধ্যাপক হয়েছেন তিনি। বর্তমানে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ার ইন অ্যাকাউন্টিং এবং বিজনেস স্কুল রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশনের প্রধান হিসেবে আছেন এই অধ্যাপক। মজার বিষয় হচ্ছে, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী (সিনিয়র প্রভাষক) ড. শামীমা হক যোগদানের মাত্র ৩ বছরের মাথায় ইউনিভার্সিটি অব এবারডিন বিজনেস স্কুলের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স ডিসিপ্লিনটি যুক্তরাজ্যের ‘দ্য কম্পলিট ইউনিভার্সিটি গাইড-২০২১ র‌্যাংকিংয়ে’ সেরা চারে এ চলে আসে (যেটা তিন বছর আগে যুক্তরাজ্যের সেরা ২০–এ ছিল)। বর্তমানে এই স্কুলের সবচেয়ে কম বয়সী অধ্যাপক তিনি। প্রথম আলোকে এবার নিজের এই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ম আজিজুল ইসলাম।
ইউনিভার্সিটি অব এবারডিন
ছবি: লেখক

অধ্যাপক পদটি হলো শিক্ষাগত জীবনের সর্বোচ্চ অবস্থান। বাংলাদেশে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করতে করতে একপর্যায়ে অধ্যাপক হয়ে যান। তবে উন্নত দেশগুলোতে বিষয়টি একটু আলাদা। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে সব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকই অধ্যাপক হতে পারেন না, বলা যায় হতে চানও না। কারণ অধ্যাপক হওয়ার ক্ষেত্রে এখানে সবচেয়ে বেশি যেটির মূল্যায়ন করা হয়, তা হলো গবেষণা। অধ্যাপক হওয়ার জন্য একজন গবেষকের মূলত বিশ্বের উচ্চমানসম্পন্ন পাবলিকেশন এবং এক্সটারনাল রিসার্চ ফান্ডিংয়ের প্রয়োজন পড়ে। তবে এখানে বলে রাখা দরকার, সব ফ্যাকালটিতে অধ্যাপক হওয়ার দৌড়টা এক রকম নয়। সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে অধ্যাপক হওয়ার জন্য অনেক বেশি এক্সটারনাল রিসার্চ ফান্ডিং দরকার। আবার বিজনেস কিংবা সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে অনেকগুলো উচ্চমানসম্পন্ন রিসার্চ আর্টিকেলের সঙ্গে কিছু এক্সটারনাল ফান্ডিং এবং টিচিং লিডারশিপের ভালো সমন্বয় থাকলে একজন শিক্ষক অধ্যাপক হতে পারেন।
বাস্তবতা হলো, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকই এখানে অধ্যাপক হতে চান না।

অধ্যাপক হওয়া মানে বেতন প্রভাষকের দ্বিগুণ হচ্ছে, তবে সেই সঙ্গে কাজটা বেড়ে যাচ্ছে তিন গুণ। আবার সেই সঙ্গে অবস্থান ধরে রাখারও একটি বিষয় আছে। অধ্যাপক অবস্থানটা ধরে রাখতে একজনকে প্রতিবছর উচ্চমানসম্পন্ন পাবলিকেশন, রিসার্চ সুপারভিশনস ও এক্সটারনাল ফান্ডিং পেয়ে যেতে হবে। যেটা বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে সম্ভব হয় না। কারণ এসব দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে গবেষণার জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য প্রণোদনা পাওয়া যায় না। অধ্যাপক হওয়ার পর থেকে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে পাবলিকেশন করার তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে গবেষণার জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য প্রণোদনাও নেই (সেই সঙ্গে শিক্ষকদের কম বেতন কিংবা অর্থকষ্টের বিষয়টি তো রয়েছেই)। তাই প্রকৃত গবেষণার সংস্কৃতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানেও গড়ে ওঠেনি। এ কারণে বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিংয়ে অনেক পিছিয়ে পড়ছে।
২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এবারডিনের বিজনেস স্কুলের অ্যাকাউন্টিং ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক হওয়ার আগে দ্রুত আবার খুবই চ্যালেঞ্জিং একটি পথ পাড়ি দিতে হয়েছে আমাকে। ২০০৯ সালে আরএমআইটি ইন্টারন্যাশনাল স্কলারশিপের (অস্ট্রেলিয়া) অধীনে পিএইচডি শেষ করি। পিএইচডি শেষ করার কিছু আগেই অস্ট্রেলিয়ার ডিকেন ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। তিন বছরের মাথায় পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র প্রভাষক হই। এরপর মাত্র এক বছরের মাথায় অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিই। এর চার বছর পর ২০১৭ সালের অক্টোবরে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এবারডিনে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিই।

ম আজিজুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

পিএইচডি শুরু করার আগে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগে প্রভাষক এবং সহকারী অধ্যাপক ছিলাম। এ কারণে তুলনামূলক আলোচনা আমার জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ। আসলে যাঁরা পিএইচডি করতে অস্ট্রেলিয়া বা যুক্তরাজ্যে যান, তাঁরা যদি সেখানকার ইউনিভার্সিটিতে একাডেমিক হিসেবে থাকতে চান, তাঁদের আসলে সবকিছু আবার নতুন করেই শুরু করতে হয়। আমার বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাকে রীতিমতো শূন্য ধরেই অস্ট্রেলিয়াতে যেতে হয়েছিল। যেহেতু রিসার্চ পারফরম্যান্সকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়, আগের কাজের অভিজ্ঞতাকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় না। এ ক্ষেত্রে আসলে একজন পিএইচডি স্টুডেন্টকে টিচিং (অথবা টিউটরিং) ও রিসার্চের মধ্যে ভালো সমন্বয় করতে হবে। খুবই উল্লেখযোগ্য হলো পিএইচডি চলাকালীন সুপারভাইজারের সঙ্গে উচ্চমানসম্পন্ন রিসার্চ আর্টিকেল লেখাটা এবং টিচিং শুরু করাটা। এই দুটির সমন্বয় যে ভালোভাবে করতে পারবেন, তাঁর তত দ্রুত চাকরি পেতে সহজ হবে। আর অধ্যাপক হওয়ার জন্য যেহেতু বিশ্বের উচ্চমানসম্পন্ন পাবলিকেশন প্রয়োজন পড়ে, পিএইচডির কাজটিই যেন উচ্চমানসম্পন্ন রিসার্চ আর্টিকেলে রূপান্তরিত হয়, তার জন্য খুব চেষ্টা করতে হবে।

আমার মতে, বাংলাদেশিরা বাইরে উচ্চমানসম্পন্ন রিসার্চে জড়িত থাকলে তা দেশের সুনাম বাড়ায়। বর্তমানে একজন মিসরীয়, একজন নাইজেরিয়ার, একজন ওমানি এবং একজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আমার অধীনে পিএইচডি করছেন। বাংলাদেশসহ নয়টি (বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পর্তুগাল, নাইজেরিয়া) দেশের একাডেমিকদের সঙ্গে আমার রিসার্চ কোলাবোরেশন রয়েছে। সব মিলিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সব কাজেই সফলতার জন্য একটি অধ্যবসয় লাগে, লেগে থাকার প্রয়াস লাগে। সর্বোচ্চ একাডেমিক অবস্থানে যাওয়াটা যার স্বপ্ন, তাঁকে পিএইচডির সময়টাকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে হবে।

*অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব এবারডিন