রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ৯ মাস চলে পিঠা উৎসব
চায়নিজ রেস্তোরাঁর মতোই আধো আলো পরিবেশ। আড্ডা তার চেয়ে জমজমাট। পার্থক্য শুধু—বসতে হয় বটতলায়, মাটিতে মাদুর বিছিয়ে। আর মেনু—সাত রকম ভর্তা দিয়ে চার পদের পিঠা। এই পিঠা খেতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের দুই হলের মাঝখানের বটতলায় মেলা বসে প্রতি সন্ধ্যায়। বছরের ৯ মাস চোখে পড়ে এই উৎসব। করোনাকালের দীর্ঘ বন্ধের পর আবারো পুরোনো সেই চেহারা ফিরে পেয়েছে বটতলা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপসী রাবেয়া ও বেগম রোকেয়া হলের মাঝখানের চত্বরে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক বটগাছ। সেখানেই আড্ডার স্বাদ বহু গুণে বাড়িয়ে দেয় মাসুদ আলীর পিঠা। পিঠা মানে ভাপা, চিতই, পাকোয়ান ও পাটিসাপটা। সন্ধ্যার পর থেকে ২১টা চুলায় বিরতিহীন তৈরি হয় পিঠা। তারপরও চাহিদা মেটাতে হিমশিম খান ১০ কর্মচারী। শিক্ষার্থীরা ছাড়া রাজশাহী শহর থেকে পিঠাপ্রেমীরাও ছুটে আসেন ক্যাম্পাসের এই বটতলায়।
৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চত্বরে পা রেখেই দূর থেকে কানে এল, ‘বকুল ফুল বকুল ফুল, সোনা দিয়া হাত কেন বান্ধাইলি।’ গাইছেন একদল ছেলেমেয়ে। কাছে গিয়ে দেখা গেল, সারিবদ্ধ চুলা জ্বলছে। পিঠা বানাতে মশগুল একদল নারী। ধোঁয়া আর বাষ্পে তাঁদের সবার মুখ অস্পষ্ট। গাছের নিচে গানে-গল্পে মেতে উঠেছেন অনেকে।
কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে পিঠা খাওয়ার আড্ডায় মেতেছেন। একটা দলে জনা বিশেক তরুণ। গান করছিলেন তাঁরাই। সবাই দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী। একজনের নাম লিটন সরকার। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষেই বাকিরা জড়ো হয়েছেন। পশ্চিমা ‘কেক’–এর বদলে বাংলায় ‘পিঠা’র সঙ্গেই জমেছে জন্মদিনের উৎসব। রেস্তোরাঁর চেয়ে এই বটতলাতেই নাকি আড্ডাটা বেশি প্রাণবন্ত হয়, বললেন শিক্ষার্থীরা। রায়হান ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী বললেন, ‘অনেক দিন বাড়িতে যাওয়া হয় না। পিঠা খেয়ে মনে হয়, মায়ের হাতের পিঠার স্বাদটা পাই।’ আরেক শিক্ষার্থী খন্দকার সৌরভ যোগ করলেন, এখানে গ্রামের একটা অনুভূতি পাওয়া যায়। ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন, ‘আমার একটা কথা আছে, পিঠার দাম কমাতে হবে।’ শুনে হাসির রোল পড়ে গেল।
দাম কমানোর কথা শুনে পিঠার দামের খোঁজ নিতে হলো। পাকোয়ান ও পাটিসাপটা ১৫ টাকা করে। চিতই ৫ টাকা ও ভাপা ১০ টাকা। আছে সাত পদের ভর্তা, বিশ টাকা দাম। এক প্লেটেই সাত পদের ভর্তা সাজিয়ে দেওয়া হয়।
ভিড়ের মধ্যে পাওয়া গেল ঠাকুরগাঁওয়ের মোস্তাফিজুর রহমান, সাবরিনা আফরিন, মাদারীপুরের উর্মি সারোয়ারসহ আরও কয়েকজনকে। কোনো উপলক্ষ আছে কি না জানতে চাইলে উর্মি সারোয়ার জানালেন, তাঁদের সবার সম্মান শেষ বর্ষের ভাইভা শেষ হয়েছে। কাল বাড়িতে যাবেন। বাড়িতে যাওয়ার আগে সময়টা উপভোগ করছেন।
বাইসাইকেল নিয়ে আসা একদল তরুণকে পাওয়া গেল। তাঁদের হাতেও পিঠা। জানা গেল, তাঁরা সবাই জাতিতে সাঁওতাল। এর মধ্যে সিলভেস্টার মুর্মু ফিন্যান্স বিভাগে, শিবলাল হেমরম আইন, সাগর সরেন আইন ও ভূমি প্রশাসন, গণেশ টুডু ইতিহাস এবং সেবাস্টিয়ান মার্ডি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। সিলভেস্টার মুর্মু সাঁওতালি ভাষায় বললেন, ‘রেয়াড় দিন ক্যাম্পাস ভিতরিরে ভাগা পিঠা জথলে হেচ কানা। জম কাতেক আমি মজলে ইকাও দা (শীতকালে ক্যাম্পাসে ভাপা পিঠা খেতে এসেছি। পিঠা খেয়ে খুব ভালো লেগেছে)।’
পিঠার এই আসর জমিয়েছেন রাজশাহী নগরের বুধপাড়া এলাকার মাসুদ আলী (৩৫)। তিনি ছোটবেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের টোকাই ছিলেন। বড় হয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। একদিন উুঁচ দালান থেকে পড়ে তাঁর মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। তিন বছর বিছানায় পড়ে ছিলেন। চিকিৎসার পর কিছুটা চলতে-ফিরতে পারেন। ছয় বছর আগে স্ত্রী মোরশেদাকে নিয়ে তিনি এই বটতলায় এসে একটি চুলা নিয়ে পিঠা তৈরি শুরু করেন। এ বছর তাঁর চুলার সংখ্যা হয়েছে ২১। মাসুদের সঙ্গে স্ত্রী, শ্বশুর, চাচি শাশুড়িসহ ১০ জন কাজ করেন। মাসুদ আলী বললেন, ‘বর্ষার তিন মাস ছাড়া সারা বছরই ব্যবসা চলে। দুই ঘণ্টায় আট থেকে ১০ হাজার টাকার বিক্রি হয়।’
বোঝা গেল, মেরুদণ্ড ভাঙার পরই মানুষটা সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখেছেন।