শিক্ষার্থীসংখ্যা বিভাজিত করে খুলুক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

ফাইল ছবি

‘স্কুলই যাচ্ছে ছাত্রের বাড়ি, সারা দেশেই অনুসরণযোগ্য’ প্রথম আলোয় সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত এমন শিরোনামের একটি সম্পাদকীয় ভীষণভাবে আমার নজর কেড়েছে (প্রথম আলো, পাতা-৮, ৩০ মে ২০২১)। পটভূমি খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের গৃহীত একটি পদক্ষেপ।

বাচ্চারা স্কুলে আসতে পারছে না। তাই উপজেলার প্রায় ৪০০ শিক্ষককে ২০০টি দলে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। একেকটি দল গ্রামে গ্রামে বাচ্চাদের কাছে যাচ্ছে। তাদের গ্রামের কোনো খোলা উঠানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জড়ো করে সপ্তাহের পড়া বুঝিয়ে আসছেন। সম্পাদক সারা দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এমন একটি ব্যবস্থা চালু করার উপযোগিতা যাচাই-বাছাই করার পক্ষে মত প্রদান করেছেন।

এ অভাজন দেশের প্রকৌশলশিক্ষা ও গবেষণায় নিয়োজিত একজন সাধারণ শিক্ষকমাত্র। জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি, ব্যবস্থাপনা, সমাজবিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে শিক্ষার মিথস্ক্রিয়া, সঙ্গে শিক্ষাকৌশলের খুঁটিনাটি এবং ব্যাপকতা নিয়ে লেখার জন্য যথেষ্ট প্রজ্ঞা, সাহস, সময় ও সামর্থ্য প্রয়োজন। তবু শিক্ষার সঙ্গে জড়িত আছি বিধায় এ ক্রান্তিকালে স্বীয় দায়িত্ববোধ থেকে কিছু সহজ ও সাধারণ চিন্তাভাবনা সুধীমহলের সমক্ষে পেশ করার জন্য কলম হাতে নিতে হয়েছে।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে অদ্যাবধি দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একপ্রকার বন্ধ হয়ে আছে। স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রম। মহামারির কারণে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অর্থনীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো রক্ষা করতে সরকারকে নানা উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংগতি রেখে ছাত্রছাত্রীদের আপাতভাবে গৃহে অবস্থান করতে হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা, অর্থনীতির সঙ্গে শিক্ষা পরিস্থিতিও। একটি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা না নিয়েই দিতে হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের ফলাফল। উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়, তথা উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে নেওয়া হচ্ছে বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ। অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষা কীভাবে গ্রহণ করা হবে, তা–ও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় না খুলে ছাত্রছাত্রীদের ঘরে অবস্থানের কারণে বিভিন্নমুখী সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা খেলাধুলা, শরীরচর্চার যথেষ্ট পরিবেশ না পাওয়ায় শারীরিকভাবে যেমন সুস্থ মানুষ হয়ে উঠতে পারছে না, তেমনি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগবঞ্চিত হয়ে মানসিকভাবেও বিকশিত হয়ে উঠতে পারছে না। শিক্ষা কার্যক্রমকে চলমান রাখার উদ্দেশ্যে স্কুল-কলেজসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এবং শিক্ষার্থীদের অনলাইন সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক পার্থক্য (যা ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ নামে পরিচিত) থাকার কারণে এসব উদ্যোগ কতটুকু কার্যকর হতে পেরেছে, তার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ দরকার।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরে থাকার কারণে বিষণ্নতার পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের ডিভাইসনির্ভরতা এবং ডিভাইস-আসক্তির জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন অনলাইন গেমের প্রতি শিক্ষার্থীরা আসক্ত হয়ে পড়ছে। ছাত্রছাত্রীদের যথার্থ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হলে পুরো ব্যাপারটা উঠে আসতো। তবে অতিরিক্ত ডিভাইসনির্ভরতার কারণে আপাতদৃষ্টে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে উঠছে বলেই মনে হচ্ছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে ক্লাসরুম সরঞ্জাম, ছাত্রাবাসসামগ্রীর ব্যাপক অবচয় হচ্ছে। তবে এসব সমস্যা বিশাল হিমশৈলের দৃশ্যমান সামান্য চূড়ামাত্র। সমস্যার বিশাল হিমশৈলটি এখনো দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। কী সংখ্যক ছাত্রছাত্রী তাদের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়ছে, বাল্যবিবাহের হার কত—এসব পরিসংখ্যান এখনো আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। সর্বোপরি একটি মেধাভিত্তিক ও জ্ঞানভিত্তিক যে সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন আমরা দেখি, সেটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে। না হলে মেধাশূন্য ও জ্ঞানশূন্য একটি ভবিষ্যৎ হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

এ মহামারিতে আমাদের সবাইকেই যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কেউ সম্মুখসারির যোদ্ধা, কেউ মধ্য সারির, আবার কেউবা পেছনের সারির যোদ্ধা। এ যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ও শিক্ষাসংকট উত্তরণের লক্ষ্যে কতিপয় বিনীত প্রস্তাব সুধীসমাজের নিকট ব্যক্ত করতে চাই। এ প্রস্তাবের মূল বিষয়বস্তু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পক্ষে—তবে অনেকটা ‘বিভাজিত করো আর জয় করো’ নীতির মতো। এখানে ‘বিভাজন’ মানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে রেষারেষির সৃষ্টি করা নয়, বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি কমিয়ে নেওয়া, যাতে বিস্তর শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়। এগুলো প্রয়োগ করার পূর্বে অবশ্যই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষাবিদদের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয় হবে।

ছবি: সংগৃহীত

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় নিম্নোক্ত উপায়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা কমিয়ে নিয়ে স্কুল খোলা যেতে পারে।
*প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলো বন্ধ না রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আংশিকভাবে খোলা রাখা যেতে পারে। শিক্ষক, কর্মচারীদের টিকা দিয়ে সপ্তাহের প্রতিদিন একটি শ্রেণির জন্য স্কুল খোলা যেতে পারে। যেমন প্রাথমিক স্কুলে সপ্তাহে এক দিন পঞ্চম শ্রেণির, অন্য দিন চতুর্থ শ্রেণির জন্য, এভাবে পাঁচ দিনে পাঁচ শ্রেণির জন্য খোলা যেতে পারে।
*একটি শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে ভাগ করে দিয়ে বিস্তর শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কোনো একটি শ্রেণিকক্ষে বাংলা, অন্য কোনো শ্রেণিকক্ষে ইংরেজি, অন্য কক্ষে গণিত বিষয়ের ক্লাস চলতে পারে। পরের পিরিয়ডে অন্য বিন্যাসে বিভিন্ন কক্ষে বিভিন্ন বিষয়ের পাঠদান চলতে পারে। এভাবে প্রত্যেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ের ক্লাসে অংশ নিতে পারে, তা ছাড়া এভাবে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাও সম্ভব।
*সুবিধা থাকলে শ্রেণিকক্ষের পরিবর্তে স্কুলের মাঠ, গাছতলা বা অন্য কোনো উন্মুক্ত স্থানেও বিস্তর শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস নেওয়ার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
*একই প্রক্রিয়ায় মাধ্যমিক স্কুলগুলোর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস বিস্তর শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে পরিচালনার কথা ভাবা যেতে পারে।

উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

গত বছর থেকে দেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস চালু হয়েছে। সমস্যা রয়েছে মূলত পরীক্ষা গ্রহণ ও ব্যবহারিক ক্লাস পরিচালনার ক্ষেত্রে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যথাসময়ে অনলাইন পরীক্ষাপদ্ধতি নির্ধারণ করে সঠিকভাবে অনলাইন পরীক্ষা নিতে সক্ষম হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

* এহেন অবস্থায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে আংশিক খোলা রেখে পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং ব্যবহারিক ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়ে নেওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারে।

*কোনো একটি বিশেষ বর্ষের এবং বিশেষ বিশেষ বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সময়ে আবাসিক হলগুলো খুলে দিয়ে বিস্তর শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে পরীক্ষা নিয়ে নেওয়া যেতে পারে। পরে অন্য সময়ে অন্য বর্ষের এবং অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হল খুলে দিয়ে একই পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কথা বিবেচনা করা যায়।

এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমসংখ্যক শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে বিস্তর শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ায় সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোভিড-১৯ এড়ানো সম্ভব। সম্ভব ক্ষেত্রে ক্লাসরুম বা পরীক্ষাগার ব্যতিরেকে মুক্ত স্থানে বিস্তর শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে আসন বিন্যাস করেও উল্লেখিত কাজ সম্পাদন করা যেতে পারে।

পাবলিক পরীক্ষাগুলো

স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসএসসি, এইচএসসিসহ অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষা বিশেষ পদ্ধতিতে নেওয়ার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
*বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের পরীক্ষাগুলো বিস্তর শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে আলাদা দিনে নেওয়া যেতে পারে।
*বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের পরীক্ষাগুলো বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা প্রশ্নপত্রে নেওয়ার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে, যাতে বিভিন্ন বিভাগের পরীক্ষা আলাদা দিনে নিলেও কোনো সমস্যা না হয়।
*এমনিভাবে সব পাবলিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমিয়ে ফেলা যেতে পারে, যাতে করে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক, তথা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হতে পারে।

পরিশেষে, কোভিড-১৯ কালের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি শিক্ষাসংকট থেকে উত্তরণের জন্য ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা থেকে উপল্লেখিত প্রস্তাবগুলো পেশ করছি। এর কার্যকারিতা যথাযথ তথ্য, উপাত্ত, তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদদের মতামত নিয়ে শিক্ষাসংকট উত্তরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সাম্প্রতিক সময়ের একান্ত দাবি।

*ড. মো. ইসমত কাদির, অধ্যাপক, ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়