সজীবতায় ভরপুর শিক্ষাজীবন চাই

চট্টগ্রাম নগরের নয়টি স্কুলে প্রাথমিকে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। ছবিটি শনিবার সকাল ১০টায় ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে তোলা। ছবি: জুয়েল শীল, চট্টগ্রাম

gcআজ এমন একটা নিউজ পেয়েছি যেটার জন্য আমি অপেক্ষা করেছি বছরের শুরুতেই। মেয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে যেদিন ক্লাস শুরু হলো, প্রথম দিনেই (১ জানুয়ারি, ২০২০) কিছু অভিভাবকের সঙ্গে দেখা হয়েছে স্কুল গেটে। তাঁদের প্রত্যেকেই জানতে চাইলেন, মেয়েকে বাসায় পড়ানোর জন্য কোনো শিক্ষক রেখেছি কি না? বললাম, না, কোনো শিক্ষক রাখিনি এখন পর্যন্ত। আমি নিজেই পড়াই।


তাঁরা জানতে চাইলেন কীভাবে আমি মেইনটেইন করি? তাঁদের অনেকেরই একটা সন্তান। কিন্তু আমার তিনটে। তাই হয়তো এ প্রশ্ন। আমি বললাম, ‘আমার কষ্ট তো অবশ্যই হয়। ঘরের সবকিছু মেনটেইন করে, ছোট বাচ্চাকে কাছে রেখে বড় দুজনকে পড়ানো, সময়মতো সবকিছু চালানো, অবশ্যই কষ্টকর। তারপরও আমি চেষ্টা করছি, দোয়া করবেন।’


তারা জানতে চাইলেন, মেয়েকে কোথাও কোচিংয়ে দিচ্ছি কি না? ‘আমি স্পষ্ট করে বলেছি, কোথাও কোচিংয়ে দেব না।’ আমি বললাম, ‘‌এ বছর কি সমাপনী ‌পরীক্ষা হবে?’ তাঁদের একজন বললেন, কোন দুনিয়ায় আছেন, কী স্বপ্ন দেখেন? অবশ্যই হবে, সেটা তো বাদ যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি বললাম, ‘না মানে একটু শুনেছিলাম প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাদ দেওয়ার একটা পরিকল্পনা হচ্ছিল, তাই জানতে চাইলাম।’

একজন আবার জানতে চাইলেন, তাহলে মেয়েকে কোথাও কোচিংয়ে দিচ্ছেন না? আমি বললাম, ‘না।’ তখন তাঁরা বললেন, আপনাদের এলাকায় একজন ভালো শিক্ষক আছেন, আমাদের সন্তানদের ওখানে দিতে চাই। কিন্তু সেই শিক্ষকের স্লট খালি নেই। তখন আমি বললাম, ‘আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারি। আমি মেয়েকে পড়াব না ওখানে। কিন্তু যেহেতু আমাদের এলাকায় বলছেন, আপনারা চাইলে আমি আপনাদের ওখানে একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারি। ওই শিক্ষকের নম্বরটা আমাকে দেবেন। পরে তাঁরা কী মনে করে আমাকে নম্বর দেননি। হয়তো ভেবেছে আমি জায়গা করে নেব ওই শিক্ষকের কাছে আমার মেয়েকে পড়ানোর জন্য।’


বরাবরই আমি একটা ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ যে আমি বাচ্চাদের যত দিন নিজে পড়াতে পারব, পরিবারে যত ঝামেলাই থাকুক, যত কষ্টই হোক আমি নিজেই ওদের পড়াব। আমি ওদের আনন্দের সঙ্গে পড়াটা বুঝিয়ে দিতে চাই। ওরা হেসেখেলেই পড়া শিখে নেবে. এটাই আমার চাওয়া। কিন্তু আমি যদি একজন শিক্ষকের কাছে ওদের পড়তে দিই, তাহলে ওরা অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট সময় শিক্ষকের কাছে বসে থাকতে হবে। ভোরবেলা উঠে স্কুলে গিয়ে, দুপুরে এসে গোসল করে, খাওয়া সেরে, নামাজ পড়ে, সামান্য সময় ওরা পায় বিশ্রামের জন্য। আসর থেকে মাগরিবের সময়টা আমি চেষ্টা করি ওদের যেকোনো খেলার মধ্যে ব্যস্ত রাখতে। একটা সময় বড় হলে হয়তো ব্যস্ততা অনেক বাড়বে। ওদের পড়াশোনার চাপ অনেক বেশি বাড়বে, তখনকারটা তখন দেখা যাবে। কিন্তু এখন এই শিশু বয়সে দুপুরবেলায় শিক্ষকের কাছে পড়াতে পাঠিয়ে ওদের মানসিকভাবে চাপ দিতে চাই না।

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা হবে—সে হিসেবে প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছিলাম। এরই মাঝে বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা হলো। সবার কাছে আমি একটা প্রশ্নই করি এই পিইসিই, জেএসসি পাস করে কী হবে? সবারই উত্তর একটাই, ষষ্ঠ আর নবম শ্রেণিতে উঠতে পারবে। আমার বিবেকের কাছে আমার প্রশ্ন, তাহলে এত কষ্ট করে বাচ্চাদের মানসিকভাবে এত চাপ দিয়ে বেশি পড়াশোনা করানোর দরকার কী? এর মাঝে আমাকে অনেকে অনেক রকমের ভালো উপদেশ দিয়েছেন। অনেকেই বলেছেন, ‘সবগুলো বই মুখস্থ করিয়ে দেন বাচ্চাকে। তাহলে আর কোথাও আটকাবে না।’ আমার প্রশ্ন একটাই, ‘আমি যদি সব মুখস্থ করাই তাহলে বাচ্চাটা কী শিখবে? কয়েকজন শিক্ষকও আমাকে এ কথা বলেছেন যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বইয়ের আগাগোড়া মুখস্থ করিয়ে ফেলেন। আমি খুব অবাক হই কীভাবে আমি এতগুলো বই এই শিশু বাচ্চাটাকে চাপ দিয়ে মুখস্থ করাব, আর এর দরকারটাই বা কি?


বরাবরই আমার মেয়েকে বলি, তুমি একটুও চাপ নিয়ো না। খুব স্বাভাবিকভাবে পড়ালেখা করো, যা হওয়ার তা–ই হবে। তুমি প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হও আমি চাই না। আমি চাই তুমি ভালোভাবে বড় হও। সুস্থ থাকো। মনের ওপর চাপ দিয়ে পড়াশোনা করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু এরপরও সিলেবাস নিয়ে পড়াতে বসলেই দেখি অনেক অনেক পড়া। বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন চলে আসে অনায়াসে। স্কুল থেকে যেসব পড়াশোনা দেওয়া হয় তা শিখতেই রাত চলে যায়। অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চাদের ঘুমাতে বলার পরও ওরা কষ্ট করে পড়া শিখতে বসে। আমার খুবই খারাপ লাগে তখন। আমি বারবার ওদের বকা দিই, এত পড়াশোনার দরকার নেই। কিন্তু ওদের মাথায় কাজ করে কালকে যদি স্কুলে পড়া না পারি? তাই কষ্ট করে হলেও ওরা পড়া শেষ করে। পঞ্চম-অষ্টম শ্রেণির যে পরিমাণ পড়ার ভলিউম দেখা গেছে, আমরা এসএসসি-এইসএসসি পরীক্ষায়ও ততটুকু পড়ালেখা করিনি। এগুলো বাচ্চাদের মানসিকভাবে চাপ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই না।

মার্চ মাস থেকে করোনার কারণে স্কুল–কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। তারপরও আমার মেয়ে নিয়মমতো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে আমাদের মনের কোনো এক জায়গায় বারবার এই আশাটা সঞ্চার হয় যে পরীক্ষা বাতিল হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না, বলতেও চাই না। তবে আমি শুধু এটুকু বলতে চাই যে সিদ্ধান্তটা হয়েছে এই করোনাকালের জন্য, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা, (পরে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা) বাতিল হলো। আমি চাই এটা অব্যাহত থাকুক। অযথা কোমলমতি শিশু বাচ্চাগুলোকে হয়রানি করার কোনো মানে হয় না। সত্যি কথা বলতে কি, এত বছর আমি ব্যাপারটা ওভাবে বুঝতাম না। কিন্তু যেহেতু এবার আমার ঘাড়ের ওপর পড়েছে বুঝতে পারছি, এই পরীক্ষাগুলো হলো বাচ্চাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেওয়া। ওদের কাছ থেকে শিশুকাল কেড়ে নেওয়া। যে বয়সটায় ওরা হেসেখেলে আনন্দের সঙ্গে পার করে দেবে, সে শিশুকালের বয়সটাই এখন পড়াশোনার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে। যেকোনো অভিভাবককে জিজ্ঞেস করলেই, একবাক্যে সবাই বলবেন এই পরীক্ষা বাতিল হওয়াই ভালো।


আগস্টের শেষ পর্যায়ে এসে ওদের সিলেবাস প্রায় শেষ হয়ে গেছে। প্রস্তুতিও হয়ে গিয়েছিল পরীক্ষার। কিন্তু এরপরও করোনার কারণে পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় ওরা যে মানসিক শান্তি পেল সেটা পৃথিবীর সবকিছুর ঊর্ধ্বে। পরীক্ষার ভীতিহীন, চাপমুক্ত একটি সুন্দর কোমল সজীবতায় ভরপুর জীবন চাই বাচ্চাদের জন্য।


* লেখক: নুসরাত সুলতানা ডিওএইচএস, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট, বায়েজিদ, চট্টগ্রাম। nusratmunir17@gm ail.com